নারীর জীবন: বৈষম্যের শিকল ভাঙার সংগ্রাম

একটি সন্তান জন্মানোর পর প্রথম প্রশ্ন ওঠে, ছেলে না মেয়ে? এই সাধারণ প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আমাদের সমাজের গভীর বৈষম্য। মেয়েরা অনেক সময় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে, আর ছেলে সন্তানের জন্ম যেন আনন্দের কারণ। ছেলেকে পরিবারের ভবিষ্যৎ, উপার্জনক্ষম এবং দায়িত্বশীল উত্তরাধিকারী হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু মেয়েদের বড় করার প্রধান উদ্দেশ্য যেন শুধু বিয়ের উপযুক্ত করে তোলা। আমাদের সমাজে এই দৃষ্টিভঙ্গি মেয়েদের মানুষ হিসেবে নয়, বরং বোঝা হিসেবে দেখে। তবে মেয়েরাও পরিবারকে সমর্থন দিতে পারে, বড় কিছু করতে পারে—এই ধারণা এখনও অনেকের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

নারী-পুরুষ দুজনেই মানুষ, কিন্তু আমরা তাদের মাঝে বিভেদ তৈরি করি। “নারীর ক্ষমতায়ন” শব্দটি যেন অপ্রয়োজনীয়—ক্ষমতায়ন কেন? নারী তো জন্মগতভাবেই সক্ষম, মানুষ হিসেবে। আমাদের সমাজে, এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও, নারীদের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। হিলারি ক্লিনটন বা কমলা হ্যারিসের মতো যোগ্য নেত্রীরা এই সমাজের গোঁড়ামির শিকার হয়েছেন। কারণ অনেকেই বিশ্বাস করেন না যে একজন নারী আমেরিকার মতো ক্ষমতাধর দেশ চালাতে পারে। তাই, এই বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি দূর করে সবাইকে মানুষ হিসেবে দেখার মানসিকতা গড়ে তোলাই প্রয়োজন।

মেয়েরা যখন বড় হয়, তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিয়ে। বিয়ে দিয়ে দিলে যেন মেয়েটি পরিবারের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যায়। সমাজের চাপ এমন যে, মেয়েটি যদি সময়মতো বিয়ে না করে, তখন সেটা বাবা-মায়ের জন্য এক বিশাল ব্যর্থতা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ ছেলের বিয়ের ক্ষেত্রে কতটা বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়! ছেলের পরিবার পাত্রীর পরিবারকে নানা প্রশ্ন করে, কিন্তু মেয়ের পরিবারকে অনেক সময় এসব সুযোগ দেওয়া হয় না। শুধু ছেলে যদি ভালো উপার্জন করে, বাড়ি-গাড়ি থাকে, তাহলে মেয়ে তাকে সঁপে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই ছেলেটি যদি অন্যায় কাজে জড়িত থাকে, বা খারাপ চরিত্রের হয়, সেসব নিয়ে খুব একটা ভাবনা হয় না। টাকা যেন একমাত্র যোগ্যতার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়।

বিয়ের পর মেয়েদের জন্য জীবন অনেক সময় যেন একটি বন্দিশালা হয়ে যায়। বাস্তবতায়, এক মেয়ের বিয়ে হয় একজন ডাক্তারকে, কিন্তু সেই পরিবার তাকে পড়াশোনা বা চাকরি করার স্বাধীনতা দেয় না। সেখানে পুত্রবধূ মানে শুধুই ঘরের কাজ, রান্নাবান্না, এবং সন্তানের দেখভাল—যেমন একটা দাসী। এমনকি শাশুড়ি বলে দেন, “বুয়ার রান্না ছেলে খায় না, তাই সারাদিন রান্না করতে হবে,” এমনকি মেয়েটিকে নিজের সন্তানদের পড়াশোনার দায়িত্বও নিতে হয়। মেয়ের বাবা-মা সব কিছু জানলেও, মেয়েটির বিয়ে ভেঙে গেলে সমাজের কাছে অপমানিত হওয়ার ভয়ে চুপ থেকে যান।

এমনকি বিয়ে ভেঙে গেলে, মেয়ের মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। শাশুড়িকে অভিশাপ দেওয়া হয়, কিন্তু সমাজে মেয়েটির অধিকার এবং স্বাধীনতা রক্ষার কথা কেউ ভাবেন না। এই ধরনের অন্ধ সামাজিক চাপ এবং বৈষম্য মেয়েদের জীবনে বারবার বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু মেয়েরাও নিজের পছন্দমতো জীবন গড়ার অধিকার রাখে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো খুবই জরুরি।

নিজের চোখে দেখেছি, বিয়ে দেওয়ার সময় কত মিথ্যার আড়ালে সত্য লুকানো হয়। কেউ বিদেশে থাকে, বড় চাকরি করে বলে পরিচয় দেওয়া হয়, কিন্তু পরে জানা যায়, সে ক্লিনারের কাজ করে। ক্লিনারদের পেশাও সম্মানের, কিন্তু কেন বিয়ের সময় এই সত্য লুকানো হয়? এমনকি কেউ যদি এই পেশায় থাকে, তবুও মেয়ের পরিবার রাজি হয় না। আবার অন্য একজনকে পরিচয় দেওয়া হয় অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্র হিসেবে, পরে জানা যায়, সে ডিগ্রিও পাননি। অনেক সময় বড় চাকরি করলেও, বিয়ের পর মেয়েকে টাকা এনে দিতে চাপ দেওয়া হয়, তার অপরাধজগতও সামনে চলে আসে। এসব দেখে, কেন বিয়ে দেওয়ার আগে যাচাই-বাছাই করা হয় না? মেয়েকে জীবনের অনিশ্চিত পথে ঠেলে দেওয়ার আগে, খেয়াল করা উচিত যে সেখানে লুকিয়ে থাকা কুমির কতটা ভয়ঙ্কর!

নারীর জীবনের প্রথম বাঁধাটি আসে তার জন্মের সময় থেকেই। আশ্চর্যজনকভাবে, এই বাধার উৎস অনেক সময় তার নিজের পরিবারের নারীরাই হয়ে থাকেন। যদি মেয়েটি উচ্চশিক্ষা নিতে চায়, অথবা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়, তাও অনেক সময় তার পরিবারের অন্যান্য নারীদের আপত্তির শিকার হয়। সমাজের চোখে, মেয়ের বিয়ে না হলে সেটা যেন এক বিশাল অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়, এবং সেই চাপ বাড়িয়ে দেয় পাশের বাড়ির ভাবী কিংবা আত্মীয়রা। কর্মক্ষেত্রে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, নারীদের পেছনে টেনে ধরার জন্য পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও কিছু অংশ দায়ী।

এই বৈষম্যের শিকড় সমাজের গভীরে প্রোথিত। ঘর থেকে রাস্তায়, কর্মক্ষেত্র থেকে সামাজিক মঞ্চ—প্রতিটি জায়গায় নারীদের সামনে বাঁধা দাঁড়ায়। একজন মেয়ের একা চলতে গেলে, তাকে যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু তাকে বিচার করে না, বরং তাকে ছোট করে, হেয় করে। এই বৈষম্য, অন্যায় এবং নিপীড়নের যাঁতাকলে প্রতিটি নারীকেই ভুগতে হয়।

পরিবর্তন আনার দায়িত্ব আমাদের সবার। যদি নারীরা একে অপরের পাশে দাঁড়ায় এবং পুরুষেরা নারীদের মানুষ হিসেবে দেখতে শেখে, তাহলে সমাজের এই গোঁড়ামি ভাঙতে সময় লাগবে না। নারীর জীবন সহজ বা সুরক্ষিত করার জন্য শুধু আইন বা নীতি নয়, প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। নারী-পুরুষ সবাই যদি মানবিক মূল্যবোধে জাগ্রত হয়, তবে হয়ত একদিন এই বৈষম্যের যুগের অবসান ঘটবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।