শামা তুবাইলি আয়নায় নিজের চুল আঁচড়ানোর চেষ্টা করতে করতে কাঁদতে শুরু করল। হাত দিয়ে মাথায় ব্রাশ চালাতে চালাতে সে সিএনএনকে বলল, “ব্রাশ দিয়ে চুল আঁচড়ানোর মতো একটুকরো চুলও আর নেই আমার মাথায়। এটা আমাকে ভীষণভাবে দুঃখিত করে তোলে। আমি আয়না ধরে থাকি, কারণ আমি আমার চুল আঁচড়াতে চাই। সত্যিই আমি আমার চুল আবার আঁচড়াতে চাই।”
এ কথা বলার সময় শামার মাথায় এক সময় ছিল লম্বা চুল, সেই স্মৃতি মনে পড়ল তার। ৭ অক্টোবর, ২০২৩ এর আগে শামা গাজার উত্তর অংশের জাবালিয়ায় তার পরিবার নিয়ে সুখী ছিল। সেখানে সে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করতে বাইরে যেত। কিন্তু সেই দিনটির পর তার জীবন পালটে যায়। শামা ও তার পরিবার, প্রায় ১৯ লাখের মতো মানুষ, তাদের বাড়ি একাধিকবার ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।
শামা বলেছিল, “আমার বন্ধুরা এখন স্বর্গে আছে। কিন্তু তাদের মধ্যে একজনের মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল মাথাহীন। তার মাথা না থাকলে সে কীভাবে স্বর্গে যাবে?” বলতে বলতে সে কাঁদে।
ডা. ইয়াসের আবু জামেই, গাজা কমিউনিটি মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রামের পরিচালক, জানান, শামার পরিবার প্রথমবারের মতো ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নির্দেশে জাবালিয়া ছেড়ে দক্ষিণের রাফায় চলে যায়। সহিংসতা বাড়লে তারা আরও একবার স্থানান্তরিত হয়ে গাজার মধ্যভাগের খান ইউনিসে একটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়।
৭ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে হামাস ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালায়, যাতে ১,২০০ জন নিহত হয় এবং ২৫০ জনের বেশি জিম্মি হয়ে পড়ে। এর পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজায় তাণ্ডব শুরু করে, এবং তাদের বেপরোয়া হামলায় ৪৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। যদিও সাম্প্রতিক এক যুদ্ধবিরতি চুক্তির কারণে দুই মাসের জন্য যুদ্ধ বন্ধ ছিল, তবুও শামার পরিবারসহ অনেক ফিলিস্তিনি পরিবার তাদের জীবন বাঁচাতে পালাতে বাধ্য হয়।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ এক রিপোর্টে জানিয়েছে, গাজায় প্রায় ১২ লাখ শিশু মানসিক সহায়তার প্রয়োজন, বিশেষত যারা বারবার যুদ্ধের বিভীষিকার সম্মুখীন হয়েছে। আর জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান টম ফ্লেচার জানায়, “এটি একটি প্রজন্ম, যারা মানসিক আঘাতে ভুগছে। তাদের অনেকেই অনাহারে, ঠান্ডায় অথবা অতি নির্দয় আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে।”
শামা তুবাইলির ক্ষেত্রে, চিকিৎসকরা জানান যে, তার চুল পড়ার প্রধান কারণ ছিল মানসিক আঘাত। বিশেষ করে গত বছরের আগস্টে রাফায় ইসরায়েলি বিমান হামলার পর তার জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, যা তার “অ্যালোপেসিয়া” নামক রোগে পরিণত হয়। অ্যালোপেসিয়া এমন একটি অবস্থা, যার কারণে মানুষের চুল পড়ে বা টাক হয়ে যায়।
এ বিষয়ে গাজার স্বাস্থ্য সেবা কর্মীরা জানান, ইসরায়েলি হামলার ফলে শিশুদের মধ্যে মানসিক আঘাত ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। গাজার পরিস্থিতিতে ৯৬ শতাংশ শিশু মৃত্যুর শঙ্কা অনুভব করছে এবং প্রায় অর্ধেক শিশু আক্রমণের পর “মরে যাওয়ার ইচ্ছা” প্রকাশ করেছে।
শামা, এই অবস্থায় শিকার হয়ে, ঘর থেকে বের হয় না বললেই চলে এবং বাইরে বের হলে মাথায় গোলাপি রঙের ব্যান্ডানা পরিধান করে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিএনএন-এর সাথে সাক্ষাৎকারে শামা বলেছিল, “আমাদের বাড়ি বোমা হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখানে আমার অনেক ছবি, স্মৃতি, জামাকাপড় ছিল, সব কিছু হারিয়ে গেছে। এখন আমাদের বাড়ি ফেরার উপায় নেই, কারণ পরিবহন খরচ অত্যন্ত বেশি, এবং সেখানে কোথায় থাকব, জানি না।”
এছাড়াও গাজার মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা জানিয়েছেন যে, তারা শিশুদের মানসিক আঘাত থেকে মুক্তি দিতে নানা ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করছেন, যার মধ্যে অঙ্কন থেরাপি অন্যতম। এতে শিশুরা তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে, যা তাদের মানসিক আঘাতের সাথে সম্পর্কিত।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে গাজার শিশুরা গভীর মানসিক আঘাতে ভুগছে, এবং তাদের সবার জন্য মানসিক সহায়তা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।