কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বহির্গমন এলাকা একটি পরিচিত দৃশ্য। এখানে, সপ্তাহের যেকোনো দিন দলবেঁধে থাকা নারীদের দেখা যায়, যারা একই রকম টি-শার্ট পরে, স্বপ্ন পূরণের উচ্ছ্বাস নিয়ে সেলফি তুলছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই নতুন চাকরিতে পাওয়া বেতনের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছেন। বেশিরভাগ নারীরই লক্ষ্য সৌদি আরবে কাজ করা, যেখানে তাঁরা গৃহকর্মীর কাজ করবেন। তাঁদের আশা—দুই বছর কাজ করার পর দেশে ফিরে নিজেকে আর পরিবারের জীবনমান উন্নত করবেন, ঘরবাড়ি তৈরি করবেন এবং সন্তানদের শিক্ষিত করবেন।
তবে এই নারীদের আশার সাথে বাস্তবতার অনেক পার্থক্য রয়েছে। যখন নাইরোবির বিমানবন্দরের আগমন এলাকায় যান, তখন দেখা যায় বেশ কিছু নারী, যারা সৌদি আরব থেকে ফিরেছেন এবং স্বপ্ন ভেঙে রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। কিছু নারী ঠিকমত বেতন পাননি, কেউ–বা দীর্ঘদিন অনাহারে ছিলেন, কেউ মারধরের শিকার হয়েছেন, আবার কেউ যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা কফিনবন্দী হয়ে দেশে ফিরেছেন।
কেনিয়া এবং উগান্ডা, আফ্রিকার দুই দেশ, দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক মন্দাবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। তাদের এক গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস হচ্ছে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। তবে সৌদি আরবের মতো দেশগুলো থেকে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ব্যাপারে কেনিয়া এবং উগান্ডা সেভাবে সহযোগিতা পায় না। সৌদি আরবে গত পাঁচ বছরে কেনিয়ার অন্তত ২৭৪ জন শ্রমিক মারা গেছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫৫, যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়, কিছু শ্রমিককে ট্রমা, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া বা পুড়ে মারা যাওয়ার মতো নানা কারণে মৃত্যুবরণ করেছে, তবে তাদের মৃত্যুর সঠিক কারণ অস্পষ্ট।
এছাড়া, উগান্ডাতেও অনেক নারী শ্রমিক সৌদি আরব থেকে ফিরে এসে অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, যদিও উগান্ডা সরকার এই সংখ্যাটি প্রকাশ করে না। সৌদি আরবে কাজ করতে যাওয়া এসব নারীদের সুরক্ষা বিষয়ে ফাবিয়ান কাউলে মুলি, যিনি কেনিয়ার শ্রমবিষয়ক কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান, কাজ করছেন। তিনি এই বিষয়ে তদন্তের দাবি তুলতে পারেন এবং সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন যাতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়।
কেনিয়া ও উগান্ডার প্রায় এক লাখ শ্রমিক বর্তমানে সৌদি আরবে কর্মরত আছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী। তাঁরা মূলত গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন, যেমন রান্না, পরিচ্ছন্নতা এবং শিশুদের দেখাশোনা। দীর্ঘদিন ধরে এই শ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, যা মূলত সৌদি আরবের পুরনো শ্রম আইন এবং অনিয়মিত নিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে হচ্ছে। এই সমস্যার এক অংশ হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন।
একদিকে, যখন সৌদি আরবের মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাইক গোল্ডস্টেইন বলেছেন, সৌদি সরকার গৃহকর্মীদের প্রতি কোনো শোষণ সহ্য করবে না এবং নির্যাতনের অভিযোগগুলোর তদন্ত করবে, তখন অন্যদিকে, কেনিয়া এবং উগান্ডার বহু শ্রমিক তাদের নিয়োগকারীদের হাতে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরছেন, এমনকি তাদের মৃত্যুও ঘটছে। এসব ঘটনাগুলোর অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠেছে যে, নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীরা।
এছাড়া, অনেক সময় নির্যাতিত শ্রমিকদের দেশে ফিরতে গিয়েও অর্থনৈতিক বাধা আসছে। সৌদি আরবের শ্রম আইন অনুযায়ী, শ্রমিকদের প্রত্যাবাসন খরচ নিয়োগকারী বা সৌদি সরকারকে বহন করতে হবে, তবে বাস্তবে অনেক শ্রমিককেই এই খরচ বহন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি, যাদের সামর্থ্য নেই, তাদের আটকে রাখার মতো ঘটনা ঘটছে।
এমনকি, কিছু অভ্যন্তরীণ সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, যারা শ্রমিকদের দাসপ্রথার মতো কাজে নিয়োগ করেছে এবং তাদের “বিক্রির জন্য” অনলাইন বিজ্ঞাপনও দিয়েছে।
সৌদি সরকারের কিছু পদক্ষেপ যেমন, গৃহকর্মীদের বেতন অনলাইনে প্রদান এবং নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে জরিমানা বাড়ানোর কথা শোনা গেলেও, বাস্তবতায় এই উদ্যোগগুলো যথেষ্ট কার্যকর হচ্ছে না। সরকারী পদক্ষেপের পাশাপাশি, কেনিয়া এবং উগান্ডার শ্রমিকরা এখনও অনেক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।