“হাওরের বুক চিরে সড়ক নির্মাণ: কৃষক ও ফসলি জমির ক্ষতি”

হাওরে বোরো ধানের সমারোহ: সড়ক নির্মাণে ক্ষতির শিকার কৃষকরা

বোরো ধান এখন হাওরের খেত-খামারে সোনালী সমারোহ তৈরি করেছে। কৃষকরা এই ধান তুলে বৈশাখে তাদের গোলায় জমা করবেন, যা তাদের বছরের পরিশ্রমের ফল। তবে, এই হাওরের বুক চিরে একটি সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে, যার কারণে কৃষকদের জীবিকা এবং পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার সাংহাই হাওরে চলমান এই সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের জন্য জমির ক্ষতিপূরণ দেওয়া দূরের বিষয়, বরং কৃষকদের ধান নষ্ট হওয়ার বিষয়েও কেউ তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না।

স্থানীয় কৃষক ও পরিবেশবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, সড়ক নির্মাণের ফলে হাওরের প্রকৃতি ও পরিবেশের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ ফসলি জমিরও ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে সড়ক নির্মাণ করলে বর্ষাকালে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে এবং হাওরের জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে, যা প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। এই পরিস্থিতি প্রশাসনের চোখের সামনে ঘটছে।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ প্রকল্পে সাংহাই হাওরে সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৪ কোটি টাকা এবং এর অর্থায়ন করছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। ঢাকার জেবি ইনোভেশন নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি বাস্তবায়ন করছে। গত বছর প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে এটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চলতি বছর আবার কাজ শুরু হয়েছে এবং মাটি কাটার কাজ চলছে।

মাটি কাটার জন্য খননযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, যার ফলে জমিতে লাগানো ধানের চারা নষ্ট হচ্ছে। খননযন্ত্রের মাধ্যমে জমি থেকে মাটি তুলে আবার রাস্তার জন্য জমিতেই ফেলা হচ্ছে, যার ফলে ১০০ ফুটের মতো ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

সরেজমিনে জানা যায়, সড়কটি পূর্ব পাড়ের ডুংরিয়া গ্রাম থেকে পশ্চিম পাড়ের হাসনাবাদ গ্রাম পর্যন্ত যাবে। এই প্রকল্পটি সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের একান্ত ইচ্ছায় নেওয়া হয়েছে। ডুংরিয়া, হাসনাবাদ, জামলাবাজ গ্রামসহ হাওরের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

স্থানীয় কৃষকরা অভিযোগ করেছেন যে, এই প্রকল্পের কাজ শুরু করার আগে তাদের কোনো আলোচনা বা ক্ষতিপূরণ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। গত বছর স্থানীয় আওয়ামী লীগের সদস্যরা কৃষকদের বাধা দেওয়ার পর তাদের ধানের দাম দেওয়ার কথা বলে ঠিকাদারের পক্ষ থেকে কিছু টাকা দেওয়া হয়েছিল। তবে বর্তমানে তারা অভিযোগ করছেন যে, এই ক্ষতিপূরণ এখনও পুরোপুরি দেওয়া হয়নি।

কিশোরগঞ্জের হাওরে সড়ক নির্মাণের জন্য সারা দেশে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। সুনামগঞ্জের হাওরে এমন সড়ক নির্মাণের ফলে হাওরের জীববৈচিত্র্য, কৃষি এবং কৃষকদের জীবিকা বিপন্ন হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা এবং জেলা প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন স্থানীয় কৃষকরা।

সাংহাই হাওরের কৃষক তারিফ মিয়া (৭০) জানান, তার প্রায় ৪ একর জমি রয়েছে, তবে সড়ক নির্মাণের কারণে ১ একরের বেশি জমি নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বলেন, “সড়ক বানানোর আগে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি, এখন আমাদের জমি ও ধান দুটোই শেষ হয়ে যাচ্ছে।” আরেক কৃষক সেলিম মিয়া (৫৫) বলেন, “এই জমি আমাদের জীবিকা। সড়ক নির্মাণের কারণে আমাদের জমি চলে যাচ্ছে এবং মাটি কাটার ফলে আরও জমি নষ্ট হচ্ছে।”

প্রকল্পের কাজ তদারকি করা আশরাফ উদ্দিন জানিয়েছেন, তারা কৃষকদের ধানের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য একটি তালিকা প্রস্তুত করেছেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী মুরাদ আহমদ জানান, “মান্নান স্যার কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করে সব ব্যবস্থা করেছেন।” তবে, শান্তিগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ বা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো বরাদ্দ নেই।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুকান্ত সাহা জানিয়েছেন, প্রকল্পের আগে জাইকা প্রকল্পের বাস্তবায়নযোগ্যতা যাচাই করেছে। তবে, যদি কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়, তা তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন।

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেছেন, কিশোরগঞ্জে হাওরে সড়ক নির্মাণ নিয়ে সারা দেশে সমালোচনা হচ্ছে। তিনি বলেন, “সুনামগঞ্জের হাওরে এমন সড়ক হলে হাওরের জীববৈচিত্র্য, কৃষি ও কৃষকদের জীবিকা বিপন্ন হয়ে যাবে।”

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেছেন, তিনি এই বিষয়টি ইউএনওর কাছে বিস্তারিত জানার জন্য বলেছেন। তিনি আরও বলেন, “হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ এবং কৃষকদের ক্ষতি করে কোনো কাজ করা উচিত নয়।”

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, গত বছর তিনি কৃষকদের ক্ষতির জন্য ঠিকাদারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলেছিলেন। তবে তিনি বর্তমানে জানেন না কীভাবে কাজ চলছে, কারণ তাকে এখন পর্যন্ত কিছু জানানো হয়নি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।