বরিশালে দারিদ্র্যপ্রবণ বিভাগের নারীর প্রতি সহিংসতা বেশি, সচেতনতা কম

বরিশাল বিভাগের দুর্দশা নতুনভাবে সামনে এসেছে। আগে, এটি দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপ্রবণ বিভাগ হিসেবে পরিচিত ছিল, তবে এখন নারীর প্রতি সহিংসতায়ও এটি শীর্ষস্থান দখল করেছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, দারিদ্র্য ও নারী নির্যাতনের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক বিদ্যমান। নারীরা অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এবং অসচেতনতার কারণে সহিংসতার শিকার হলেও প্রতিবাদ করতে পারেন না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সম্মিলিত উদ্যোগ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) যৌথভাবে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ-২০২৪’ প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যায়, সারা দেশে ৭৫.৯% নারী জীবনে একবার অন্তত নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বরিশাল বিভাগে এই হার ৮১.৫%, যা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। খুলনা বিভাগেও একই হার ৮১.৫%, তবে সিলেট বিভাগের নারী নির্যাতনের হার সবচেয়ে কম, ৭২.১%। এ জরিপের প্রতিবেদন ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে প্রকাশ করা হয়।

বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র জনগণ বাস করছে, যার দারিদ্র্য হার ২৬.৬%। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বিভাগের দারিদ্র্য হার সবচেয়ে কম, মাত্র ১৫.২%।

বরিশালে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা আইসিডিএ’র সভাপতি আনোয়ার জাহিদ বলেন, বরিশাল বিভাগের দারিদ্র্যের পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, নদীভাঙন, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, কৃষি উৎপাদনে পিছিয়ে থাকা, শিল্পকারখানার অভাব এবং সঠিক কর্মসংস্থানের অভাব।

নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে দারিদ্র্যের প্রভাব স্পষ্ট। বি.বি.এস এবং ইউএনএফপিএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়, নারী নির্যাতন বিভিন্নভাবে হতে পারে—শারীরিক, মানসিক, আর্থিক এবং যৌন নির্যাতন। দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে নারীরা সহিংসতার শিকার হলেও প্রতিবাদ করতে পারেন না। এছাড়া সামাজিক রীতিনীতি, কুসংস্কার এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়াও নির্যাতন বৃদ্ধির একটি কারণ।

বরিশালে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা বিএম কলেজের সাবেক অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, বরিশাল দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হওয়ায় এখানে নারীরা স্বামী ও স্বজনদের নির্যাতনের শিকার হন। আয়রোজগারের সীমিত সুযোগ থাকার কারণে নারীরা পুরুষদের ওপর নির্ভরশীল, এবং আর্থিক স্বাধীনতা না থাকায় নির্যাতনের শিকার হলেও তারা সহজে বেরিয়ে আসতে পারেন না। অনেক সময় নির্যাতনের বিরুদ্ধে মামলা হলেও বিচার না হওয়ার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে ওঠে।

নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পর্কে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ধারণা এখনও অস্পষ্ট। বেশিরভাগ নারী পারিবারিক বা সামাজিক সহিংসতার তীব্রতা ও ধরনের পার্থক্য বুঝতে পারেন না। এমনকি সরকারী-বেসরকারী প্রচারণা সত্ত্বেও সঠিক সচেতনতার অভাব রয়ে গেছে।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের জরিপে দেখা গেছে, ২০২০-২১ সালে দেশের ৪০টি জেলায় পরিচালিত জরিপে বরিশাল, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলা অন্তর্ভুক্ত ছিল। জরিপে দেখা যায়, অধিকাংশ মানুষ ধাক্কাধাক্কি, থাপ্পড়, পাথর ছোড়া এবং উত্ত্যক্তকরণকে সহিংসতা হিসেবে বিবেচনা করেন না। মাত্র ৩৫% নারী সহিংসতার যে কোনো অশোভন আচরণকে সহিংসতা মনে করেন, আর ৫৬% নারী কেবল যৌন হয়রানিকে সহিংসতা হিসেবে মেনে নেন। ২৩% মনে করেন, নারীকে সহ্য করে সহিংসতা সম্পর্কিত আচরণ উপেক্ষা করা উচিত।

বিচারহীনতার সংস্কৃতিও সহিংসতার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অনেক নারী জানান, তারা কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাঙ্গন বা সাধারণভাবে যাতায়াতের সময় প্রায়ই যৌন হয়রানির শিকার হন, কিন্তু একা থাকায় প্রতিবাদ করতে পারেন না। সামাজিক ও পারিবারিক চাপের কারণে অনেক সময় অভিযোগ তুলে নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়।

বরিশাল মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পুষ্প রানী চক্রবর্তী বলেন, শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ না মানুষের বোধ জাগ্রত হবে। তিনি বলেন, সমাজে প্রচলিত কিছু ধারণা, বিশেষ করে পুরুষের ক্ষমতাশালী হওয়া এবং নারীকে পুরুষের অধীন করা, যৌন সহিংসতার একটি বড় কারণ। বিচারহীনতার সংস্কৃতিও সহিংসতা বৃদ্ধির অন্যতম এক কারণ।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বহুমুখী উদ্যোগ প্রয়োজন। দক্ষিণাঞ্চলে নারীদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করা জাগো নারীর প্রধান নির্বাহী হোসনে আরা বলেন, গ্রামে ও চরাঞ্চলে নারী নির্যাতনের হার বেশি, যেখানে পুরুষের বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ এবং নারীদের ওপর সহিংসতা একটি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সমস্যার সমাধানে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধি এবং নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ সুবিধা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

বরিশাল মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক মেহেরুন নাহার বলেন, নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে, পাশাপাশি নির্যাতন প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর জন্য নানা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।