ছয় মাস ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে এগোতে পারেনি। রপ্তানি খাত ছাড়া প্রায় সব অর্থনৈতিক সূচকেই নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি এখনো দুই অঙ্কের ঘরে, ব্যাংক ঋণ এবং এলসি সমস্যার কারণে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কর্মসংস্থান সংকটের কারণে বেকার হচ্ছেন অনেক শ্রমিক।
এছাড়া, প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না, ছোট-বড় প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে এবং নতুন প্রকল্পের জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগও কমে গেছে, ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা নানা সংকটে পড়েছেন। এসব সংকটের কারণে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশের অর্থনীতি বর্তমানে উল্টো পথে চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক চিফ ইকোনমিস্ট এবং বিআইডিএস-এর সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কামাল মুজেরি বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অর্থনীতির কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটেনি। বরং নীতি গ্রহণে দুর্বলতা এবং সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যার ফলে অর্থনীতির গতিশীল সূচকগুলো স্থবির হয়ে পড়েছে।”
রাজস্ব আয়ে ঘাটতি এবং বাজেটের চ্যালেঞ্জ
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, সামষ্টিক অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটের হিসাব-নিকাশ মেলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে রাজস্ব আয়ের ঘাটতি এবং প্রত্যাশিত বৈদেশিক সহায়তা না পাওয়ায় সরকারের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকার চলতি অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে ভ্যাট বাড়ানোর মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়, তবে গণচাপে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়েছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও সুদহারের বৃদ্ধির সম্ভাবনা
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও এটি এখনো দুই অঙ্কের ঘরে রয়েছে, যা দাঁড়িয়েছে ১০.৮৯ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের নীতিনির্ধারকরা সুদহার বাড়ানোর দিকে ঝুঁকছেন, তবে এই পদক্ষেপ বেসরকারি খাতের সংকট আরও বাড়াতে পারে, বলেছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।
বৈদেশিক সহায়তা ও রাজস্ব আয় কমেছে
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশে বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া গেছে ৩.৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছর একই সময়ে পাওয়া সহায়তার তুলনায় প্রায় ৫৩ মিলিয়ন ডলার কম।
এছাড়া, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর হিসাব অনুযায়ী, জুলাই-ডিসেম্বরে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা কম হয়েছে।
বিনিয়োগের পরিস্থিতি ও শিল্পকারখানায় সংকট
দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগও কমে গেছে। রপ্তানিমুখী অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মধ্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় ২২% কমেছে, যা গত ছয় মাসে একটি বড় পতন। পানিসংকট এবং জ্বালানিসংকট বিশেষভাবে বিনিয়োগের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিজনেস প্লানগুলোর মধ্যে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খুলতেও কমছে, যা দেশের শিল্প খাতে বিনিয়োগের অভাবের সংকেত দিচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলার হার গত বছরের তুলনায় ২৬% কমেছে। এর ফলে, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে, যা গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
সব মিলিয়ে, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, যদি এই অবস্থা চলতে থাকে, তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও বেশি সংকটে পড়তে পারে।