সাক্ষরতা বা Literacy আমাদের কাছে পরিচিত একটি ধারণা। এটি মূলত পড়া এবং লেখা জানার ক্ষমতাকে নির্দেশ করে। যদি কোনো ভাষাভাষী জনগণ তাদের মাতৃভাষার বর্ণগুলো চিনতে পারে এবং সেগুলো ব্যবহার করে পড়তে এবং লিখতে সক্ষম হয়, তবে তাকে সাক্ষর ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে, অ্যামেরিকান শিক্ষাবিদ এবং সাহিত্য সমালোচক E. D. Hirsch (জন্ম : ২২ মার্চ, ১৯২৮) সংস্কৃতিগত সাক্ষরতার ধারণাকে শুধুমাত্র পড়া এবং লেখা জানার সীমিত অর্থের মধ্যে আটকে না রেখে, এর বিশালতাকে আরও ব্যাপকভাবে তুলে ধরেছেন। তার Cultural Literacy (১৯৮৭) গ্রন্থে তিনি সাক্ষরতা সংক্রান্ত আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন, যেখানে তিনি পাঠসংক্রান্ত জগৎ বা Context এর সঙ্গে পরিচয়ের গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ, একজন সাক্ষর ব্যক্তি যখন কোনো লেখা (Text) পড়েন, তার বোঝার ক্ষমতা নির্ভর করে তার পাঠসংক্রান্ত বিশ্বের (Context) সঙ্গে পরিচয়ের গভীরতার উপর। প্রথাগত সাক্ষরতা মূলত ভাষার উপাদানগুলো যেমন বর্ণ, শব্দ, ব্যাকরণ, এবং শব্দভাণ্ডারের সাথে সম্পর্কিত, তবে সংস্কৃতিগত সাক্ষরতা আরও বিস্তৃত এবং গভীর। এতে মননের, সৃজনশীলতার এবং অভিজ্ঞতার বিশাল ভূমিকা রয়েছে, যা শুধু যান্ত্রিক স্মৃতি নয়।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, যেসব ব্যক্তি স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পাস করেছেন এবং শিক্ষিত বা উচ্চশিক্ষিত হিসেবে পরিচিত, তারা সংস্কৃতিগত সাক্ষরতা কতটা অর্জন করেছেন?
প্রত্যেক জাতি-গোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতিগত ঐতিহ্য থাকে, এবং তাদের সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে ভাষার সাহিত্যে সেটি প্রকাশ পায়। সংস্কৃতিগত সাক্ষরতা অর্জন করা এমন জনগণের অধিকারী যারা তাদের মাতৃভাষার সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে যুক্ত, যারা সাহিত্য পাঠে অভ্যস্ত এবং যাদের শিল্পকলার প্রতি আগ্রহ ও কৌতূহল রয়েছে। তবে, এটি সহজ বা একদিনে অর্জিত কিছু নয়; এটি একটি দীর্ঘ শিখন-শেখানোর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যে যখন শিশুরা একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে, তখন তারা শুধু পড়া এবং লেখা শিখে না, বরং সে শিক্ষা তাদের সংস্কৃতিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে তাদের চিন্তা, অনুভূতি, এবং প্রয়োগের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলভাবে বেড়ে ওঠে, এবং এই প্রক্রিয়া শুধু শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে নয়, বরং তাদের পারিপার্শ্বিক অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং পেশাগত পরিবেশের মধ্য দিয়েও ঘটে। E. D. Hirsch এই অবস্থাকে ‘Symbol of the melting pot’ বা একত্রীকরণের প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
প্রতিটি জাতি বা জনগণের সংস্কৃতির কিছু চিহ্ন এবং প্রতীক থাকে, যেগুলো তাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস, আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছেদ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। একজন শিশুর জন্য, পড়া এবং লেখা শিখে সেই চিহ্ন এবং প্রতীকের সাথে পরিচিত হওয়া তার সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিভিন্ন ভাষায় এমন কিছু শব্দ এবং বাগধারা রয়েছে যা ওই ভাষার সংস্কৃতির মূর্ত বা বিমূর্ত চিহ্ন হিসেবে কাজ করে, যা প্রথাগত সাক্ষরতার সীমায় অন্তর্ভুক্ত নয়।
একটি উদাহরণ হতে পারে, ক্লিন্ট বি. সিলির বাংলা ভাষা শেখার অভিজ্ঞতা। তিনি দোকানদারকে ‘বুঝেছেন?’ বলে জিজ্ঞেস করলেও, দোকানদার তাকে ‘কলাডা’ (banana) বলতে বলেছিলেন। এর মাধ্যমে প্রতিভাত হয় যে, ভাষার মধ্যে সংস্কৃতিগত এবং সাংস্কৃতিক ভিন্নতা নিহিত থাকে।
পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গ্রন্থকেন্দ্রিক বা bibliocentric সংস্কৃতি হিসেবে পরিচিত, যেখানে বাইবেল, শেক্সপিয়র, থোমাস ক্রেনমারের কাজগুলো গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এমনকি পাশ্চাত্য সভ্যতার অনেক গ্রন্থ আজও তাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে প্রতিপন্ন হচ্ছে। আমাদের দেশেও সংস্কৃতির পুরনো ধারা রয়েছে, যেমন চর্যাপদ, পদাবলি, এবং শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন যা আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতির ভিত্তি তৈরি করেছে।
তবে, বর্তমান সময়ে সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান একত্রে বিকাশের পরিবর্তে কিছু ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা এবং সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে। সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্যের মধ্যে সম্মান এবং একত্রিত হওয়ার জায়গাগুলির উপস্থাপন আমরা যদি করি, তবে একে একীভূত করা সম্ভব।
একটি শিশুর সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা অর্জন তার পরিবার এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। যদি কোনো শিশুর পরিবারে ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক সংকীর্ণতা থাকে, তাহলে তার সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা অর্জন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। পরিবার এবং শিক্ষকদের দায়িত্ব হল শিশুকে এই বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক চিহ্ন, প্রতীক এবং বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচিত করে তোলা।
সংস্কৃতিগত সাক্ষরতা অর্জন একজন শিশুকে তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেয়, যার মাধ্যমে সে অন্য সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সম্মানজনক আচরণ শেখে। এটি তাকে পরস্পরের মধ্যে সংলাপের সুযোগ দেয় এবং তাকে সমাজে আরো সৃজনশীল এবং সমৃদ্ধি অর্জনের পথ দেখায়।
এই সাংস্কৃতিক শিক্ষা, বা enculturation, শিশুর পরিবার থেকেই শুরু হয়, যেখানে সে প্রথম দিকেই জীবনের মৌলিক শিক্ষা পায়, যেমন স্বাস্থ্য সচেতনতা, পরিচ্ছন্নতা, আচরণ, এবং বিশেষ সংস্কৃতিগত পরিচয়। শিশুর মধ্যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং শ্রদ্ধা বোধ তৈরি করার জন্য, আমাদের প্রয়োজন সঠিক শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সংস্কৃতিগত সাক্ষরতা প্রসারিত করা।