ঢাকার সাহ্রির পরম প্রিয় খাবারের মধ্যে ছিল কোরমা ও শীরবিরিঞ্জ, যা মূলত দুধের পায়েসের একটি প্রকার। সাধারণত, সন্ধ্যায় রান্না করা খাবারের মধ্যে কিছু পদ সাহ্রির জন্য রেখে দেওয়া হতো। আর শেষ রাতে, মূলত ভাত রান্না করা হতো। সাহ্রিতে শীরমাল রুটি বা ভাত—দুটিই জনপ্রিয় ছিল। কোফতা বা কালিয়া ভাজা একটি পছন্দের খাবার ছিল, যা রুটি কিংবা ভাতের সঙ্গে খুব ভালোভাবে মানিয়ে যেত। অন্যদিকে, আহসান মঞ্জিলের খাজা সাহেবরা বিশেষভাবে সাবুদানার শীরবিরিঞ্জ পছন্দ করতেন।
‘ঢাকা আজ সে পাচাস্ বারস্ পেহেলে’—এই উর্দু বাক্যের বাংলা অর্থ ‘ঢাকা ৫০ বছর আগে’। এটি হেকিম হাবিবুর রহমানের একটি বইয়ের নাম, যিনি বিশ শতকের শুরুর দিকে পূর্ব বাংলার একজন প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ছিলেন। বইটি ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের লাহোর থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এতে উনিশ শতকের শেষ দিক ও বিশ শতকের প্রথম দিকে ঢাকার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে, যা ঢাকার সংস্কৃতির গবেষকদের মতে, কোনো রচনায় এত বিস্তারিতভাবে পাওয়া যায় না। এটি শুধু সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সাহিত্যের দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বইটির মাধ্যমে জানা যায়, প্রায় এক শ থেকে এক শ পঁচাশি বছর আগে ঢাকায় পবিত্র রমজান মাসের সময় জনজীবন ও সংস্কৃতির নানা দিক কিভাবে ছিল। আজকাল, রোজা রেখে ইফতারের পর এক কাপ চা বা কফির জন্য অনেকেই অপেক্ষা করেন, কিন্তু সে সময় ঢাকায় চায়ের প্রচলন এতটা ছিল না। হেকিম হাবিবুর রহমান তাঁর বই ‘শেফাউল মুলক’–এ উল্লেখ করেছেন যে, ঢাকায় চা শুধু মোগল ও কাশ্মীরিদের বাড়িতেই তৈরি হতো, এবং তাঁরা ইফতার ও সাহ্রিতে চা পান করতেন। তাঁদের মতে, সাহ্রিতে চা পান করলে দিনের বেলা পানি কম খেতে হয়। যারা হুঁকা টানতেন, তাঁরা সাহ্রির পর একবার তামাক সহযোগে ধূমপান করতেন এবং ইফতারের পরও হুঁকা টানতেন।
এছাড়া, বইটি থেকে জানা যায়, পবিত্র রমজান মাসে ঢাকার ‘কারবারি’ মানুষরা ভোরে কাজ শুরু করতেন, কিন্তু বিত্তশালী পরিবারের সদস্যরা সকাল পর্যন্ত শুয়ে থাকতেন। সে সময়, ঢাকার অনেক অঞ্চলে সকালের রুটি দোকানগুলি বন্ধ থাকত, এবং যারা রোজা রাখার বয়সে পৌঁছাননি, তাদের জন্য আগের রাতে রুটি প্রস্তুত করা হতো। সেসময়, রাস্তায় পান বা তামাক খাওয়া কোন মুসলমানকেও দেখা যেত না।
এছাড়া, বইতে ইফতার প্রস্তুতির প্রস্তুতি নিয়েও বর্ণনা রয়েছে। ইফতারের সময়, পুরুষেরা ঘরের নারীদের সাহায্য করতেন এবং ডাল বেটে ফুলুরি তৈরি করা হতো। ইফতারের অপরিহার্য খাবার ছিল মুড়ি, যা পেঁয়াজ, মরিচ ও তেল দিয়ে মাখা হতো। অনেক বাড়িতে জমজমের পানি, শরবত এবং তোকমার বা বেলের শরবতও জনপ্রিয় ছিল। এর সঙ্গে থাকত মিষ্টি, নোনতা সমুচা, ভাজা পনির এবং মাখনা।
তখনকার দিনে রেফ্রিজারেটর ছিল না, তবে পানি ঠান্ডা রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। ঢাকার প্রতিটি বাড়িতে কূপ ছিল, এবং পানির পাত্রটি কূপে নামিয়ে রাখার মাধ্যমে তা ঠান্ডা করা হতো। ইফতারের আগে সেই পানি উঠিয়ে পান করা হতো, যা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যেত।
তখনকার দিনে মসজিদে ইফতার পাঠানোর রেওয়াজও ছিল, যা এখনো কিছু জায়গায় চালু রয়েছে। হেকিম হাবিবুর রহমান, যিনি সেই সময়ের ঢাকা নিয়ে লিখেছিলেন, এখন যা পুরান ঢাকা হিসেবে পরিচিত, সেখানে মূলত সেদিনকার ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন। তবে বর্তমানে জনবিন্যাসের পরিবর্তনে সেই পুরান ঢাকার সংস্কৃতি অনেকটাই বদলে গেছে।
সাদ উর রহমান, হেকিম হাবিবুর রহমানের প্রপৌত্র, যিনি নিজেও ঢাকা সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছেন, বলেছিলেন যে সময়ের পরিবর্তনের সাথে জীবনযাপন ও সংস্কৃতিতে কিছু পরিবর্তন আসাটা স্বাভাবিক। তবে পুরান ঢাকার কিছু বাসিন্দারা এখনো ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন, এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য তুলে ধরার গুরুত্বও তিনি উল্লেখ করেন।