“যেভাবে শজনে উপার্জন করছে লাখ লাখ টাকা”

শজন গাছের ডাঁটা নুয়ে পড়েছে। চৈত্রের রোদে পাহাড়জুড়ে ঝলমল করছে শজনের বাগান। ডাঁটা তোলার কাজে ব্যস্ত শ্রমিকেরা, আর তিন কিলোমিটারজুড়ে চলছে কর্মচাঞ্চল্য—ডাঁটা সংগ্রহ, বাছাই এবং মাপ দেওয়ার কাজ। রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার ওয়াগ্গা ইউনিয়নের উত্তর দেবতাছড়ি গ্রামে এমনই একটি শজনের বাগান দেখা গেছে।

এটি শুধু দেবতাছড়ি গ্রামেই নয়, পাশের ছোট পাগলী, বড় পাগলী ও দক্ষিণ দেবতাছড়ি গ্রামেও শজনের চাষ হচ্ছে। কাপ্তাই উপজেলার ওয়াগ্গা ইউনিয়নেই সবচেয়ে বেশি শজনে চাষ হয়। দেবতাছড়ি গ্রামে ৭২টি পরিবার রয়েছে, যার মধ্যে ৯০ শতাংশ পরিবার জীবিকা নির্বাহের জন্য শজনের চাষে নির্ভরশীল।

উত্তর দেবতাছড়ি গ্রামের শজন চাষি বিমল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, “আমাদের গ্রামে দু-একটি পরিবার ছাড়া সবাই শজন চাষ করেন। আমি এই বছর দুই লাখ টাকার ওপরে শজনের ডাঁটা বিক্রি করতে পারব। গত বছর আড়াই লাখ টাকার ডাঁটা বিক্রি করেছি।” চলতি বছর, কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের চেলাছড়া উপরপাড়ার বুদ্ধ কুমার চাকমা তিন লাখ টাকার শজনের ডাঁটা বিক্রির আশা করছেন।

ওয়াগ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চিরঞ্জিত তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, “আমার ইউনিয়নে চারটি পাহাড়জুড়ে শজনের বাগানে ডাঁটার ফলন এসেছে। ইতিমধ্যে ডাঁটা বিক্রির ধুম পড়েছে। উত্তর দেবতাছড়ি সহ চার-পাঁচটি গ্রামের প্রায় সবারই শজনের বাগান রয়েছে।”

শজন গাছের বৈজ্ঞানিক নাম মরিঙ্গা ওলেইফেরা। এর ফল, ফুল, পাতা ও শিকড় খাদ্য এবং ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে শজনের ডাঁটা সবজি হিসেবে খুব জনপ্রিয়। শজনের পাতা বহুদিন ধরে পুষ্টিগুণে ভরপুর বলবর্ধক হিসেবে খাওয়া হয়ে থাকে। সম্প্রতি শজনের পাতা থেকে চা ও তেল তৈরি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ছাড়াও শজন গাছ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও দেখা যায়।

চাষিরা জানান, একবার শজন গাছ লাগালে দীর্ঘ বছর ফলন পাওয়া যায় এবং এতে সার, কীটনাশক বা কোনো বাড়তি পরিচর্যা দরকার হয় না। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শজনের ডাঁটা বিক্রি শুরু হয় এবং জুলাই থেকে শজনের পাতা সংগ্রহ করা হয়, যা চার মাস পর্যন্ত চলে। পাতা শুকিয়ে বিক্রি করা হয় এবং প্রতি কেজি শুকনা শজন পাতা ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়।

শজনের ডাঁটা সংগ্রহের জন্য দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ীরা দেবতাছড়ি পাহাড়, রামপাহাড়, সাপছড়ি পাহাড়, এবং ছোট পাগলী পাহাড়ে ভিড় করেন। প্রতিদিন দুই থেকে তিন ট্রাক ডাঁটা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয়। মৌসুমের শুরুতে প্রতি কেজি ডাঁটা ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হলেও বর্তমানে দাম ১০০ থেকে ১২০ টাকা হয়ে গেছে।

কাপ্তাই কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শজন চাষে খরচ কম এবং লাভ বেশি। চলতি বছর কাপ্তাই উপজেলায় ৬৩ একর জমিতে শজনের বাগানে ফলন এসেছে, যা থেকে ৫০০ মেট্রিক টন ডাঁটা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় বাড়ির উঠানে একটি কিংবা দুটি শজন গাছ লাগানো হচ্ছে এবং এই চাষ দিন দিন বাড়ছে।

কাপ্তাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ইমরান আহমেদ বলেন, “পাহাড়ে শজন চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবছর ডাঁটা ও পাতা বিক্রি করে ভালো আয় করা সম্ভব। কাপ্তাইয়ে চলতি বছর ৬৩ একর জমিতে শজনের ডাঁটার ফলন এসেছে এবং ৫০০ মেট্রিক টন ডাঁটা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।