“বাজেটে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান সিপিডির”

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের অগ্রাধিকার দেয়ার আহ্বান সিপিডির

আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তারা বলছে, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বিনিয়োগ আকর্ষণে উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে দুর্বল এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে পদক্ষেপ নিতে হবে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে সিপিডি বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করেছে। তারা জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি ছিল, যেখানে শহর ও গ্রামে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের চেয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি। সিপিডি মনে করে, মূল্যস্ফীতির কারণে স্বল্প আয়ের মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে এবং গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে এটি আরও বৃদ্ধি পাবে।

একটি মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সিপিডির গবেষকরা এই সুপারিশগুলো তুলে ধরেন। গতকাল রোববার, রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডির কার্যালয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান এবং গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আগামী বাজেটের জন্য দূরদর্শী এবং সমন্বিত নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মুদ্রানীতির পুনরুদ্ধার বর্তমানে নীতিনির্ধারকদের অন্যতম প্রধান কাজ, যার জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা এবং আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষা জরুরি।

রাজস্ব ঘাটতি বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি

চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ৩২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও, প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) মাত্র ৪.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সিপিডি আশঙ্কা করছে, চলতি অর্থবছরের শেষে রাজস্ব ঘাটতি ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে।

প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) বাজেট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ৭ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। সিপিডি বলছে, বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে, যার ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রভাব কমে যাচ্ছে।

ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার এবং রিজার্ভ পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও, সিপিডি মনে করে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যস্ফীতি ৭-৮ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে। সিপিডির পূর্বাভাস অনুযায়ী, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.২৫ শতাংশ হতে পারে, যদিও সরকারের লক্ষ্য ছিল ৭.৭৫ শতাংশ।

আরও সুপারিশ

সিপিডি তাদের সুপারিশে বলেছে, রাজস্ব ঘাটতি মোকাবেলা করতে সরকার কৃচ্ছ্র সাধন বজায় রাখবে, তবে আগামী বাজেটের রাজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত করতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়ানোর চেয়ে সরকারের ব্যয় দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। বিশেষত, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও আইএমএফের শর্তের কারণে সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব যেন না পড়ে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

সিপিডি আরও বলেছে, করদাতাদের জন্য একটি ঝামেলামুক্ত কর ব্যবস্থার প্রয়োজন, এবং এর জন্য একটি বাস্তবায়নযোগ্য ও সামঞ্জস্যপূর্ণ করনীতি গঠন করা উচিত। তারা ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামানোর প্রস্তাব দিয়েছে।

২০২৬ সালে বাংলাদেশ যখন এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে চলে যাবে, তখন রপ্তানি খাতে সহায়তা ধাপে ধাপে কমিয়ে দেওয়া হবে। সিপিডি পরামর্শ দিয়েছে, রপ্তানিকারকদের বিকল্প সহায়তা প্রদান করতে হবে।

বিদ্যুৎ এবং গ্যাস খাতে সুপারিশ

সিপিডি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বাতিলের পরামর্শ দিয়েছে। গ্যাস খননে গতি বাড়ানোর জন্য পেট্রোবাংলাকে বিদেশি ঋণদাতাদের ওপর নির্ভর না করে গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থ ব্যবহার করার প্রস্তাবও দিয়েছে।

স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির সুপারিশ

আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য সিপিডি সুপারিশ করেছে। তারা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের আমদানি করা বইয়ের ওপর শুল্ক প্রত্যাহার, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের করপোরেট কর কমানোর (১৫% থেকে ১০%) এবং শিক্ষা উপবৃত্তি বৃদ্ধি করার পরামর্শ দিয়েছে। তারা স্কুল ফিডিং কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর কথাও বলেছেন।

অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন এবং ডিজিটালাইজেশনেও বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন সিপিডি। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য এটি একটি বিরল সুযোগ, যেখানে ডিজিটালাইজেশনে বিনিয়োগ করলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য অনেক বেশি সুফল বয়ে আনবে।”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।