বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে জেলা প্রশাসক (ডিসি) হওয়ার আগ্রহে এখন এক ধরনের ভাটা দেখা দিয়েছে। আগে যেখানে ডিসি পদের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ ছিল, তদবিরও ছিল, সেখানে বর্তমানে অনেক কর্মকর্তাই সাক্ষাৎকারে উপস্থিত হচ্ছেন না, যদিও তাঁরা ডাক পেয়েছেন।
এখন পর্যন্ত দুটি ব্যাচের মোট ২৬৯ কর্মকর্তাকে ডিসি পদে নিয়োগের জন্য সাক্ষাৎকারে ডাকা হয়েছে, তবে তাদের মধ্যে মাত্র ১৩৬ জন উপস্থিত হয়েছেন, অর্থাৎ প্রায় ৪৯ শতাংশ কর্মকর্তা সাক্ষাৎকারে অনুপস্থিত ছিলেন।
জেলা প্রশাসক পদটি সব সময়ই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য আকর্ষণীয় ছিল, কারণ এটি মাঠ প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ। তবে বর্তমানে এটি নিয়ে কর্মকর্তাদের আগ্রহ কমে আসার কারণ হিসেবে বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে। প্রথমত, বিতর্কিত এবং একতরফা নির্বাচনের সময় ডিসি পদে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তারা এখন জবাবদিহির মুখে পড়ছেন। অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁদের সম্পদ অনুসন্ধান করছে। এর ফলে, ডিসি পদে দায়িত্ব পালনের জন্য ঝুঁকি বাড়ছে, বিশেষত আগামী জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের সময়। গত ফেব্রুয়ারিতে ৪৩ জন কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়, যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়া, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে ডিসি পদে দায়িত্ব পালনকারী ২২ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, মাঠ প্রশাসনে বর্তমানে নানা ধরনের রাজনৈতিক চাপ রয়েছে, যার ফলে ডিসি পদে কাজ করা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। স্থানীয় নেতারা বিভিন্নভাবে হস্তক্ষেপ করছেন এবং কাজে বাধা দিচ্ছেন, যা ডিসি হিসেবে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগকে সীমিত করে দিচ্ছে।
তৃতীয়ত, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে ডিসি পদে দায়িত্ব পালনকারীরা পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের দৃষ্টিতে কীভাবে মূল্যায়িত হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
চতুর্থত, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভালো পদে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তারা মনে করছেন, তাঁদের ডিসি পদে নিয়োগের সম্ভাবনা নেই, তাই তারা সাক্ষাৎকার দিতে আগ্রহী হচ্ছেন না।
পঞ্চমত, এখনকার প্রশাসনে অনিয়ম বা দুর্নীতির সামান্য অভিযোগ উঠলে শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে, যার ফলে ডিসি পদে যেতে এখন কর্মকর্তাদের জন্য ঝুঁকি বাড়ছে।
তবে, জেলা প্রশাসক পদটি একসময় ছিল অত্যন্ত সম্মানজনক ও শক্তিশালী। ডিসি হিসেবে থাকা মানে ছিল জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে পরিচালনা করা, যেখানে নানা ধরনের ক্ষমতা, সুবিধা এবং সম্মান ছিল। ডিসিদের জন্য একটি বড় বাংলোবাড়ি, একাধিক দামি গাড়ি, পুলিশি প্রহরা, এবং অন্যান্য সুবিধা ছিল। তবে, এ পদে যাওয়া এখন অনেকের জন্য ঝুঁকির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এবারের ডিসি নিয়োগে কর্মকর্তাদের উপস্থিতি কম হওয়ায় সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, কম দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের ডিসি পদে নিয়োগের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। বর্তমানে, ডিসি পদে যোগ্য হতে হলে একজন কর্মকর্তার দুই বছরের মাঠ প্রশাসনের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এই নিয়মে শিথিলতা আনা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি ডিসি নিয়োগের জন্য সাক্ষাৎকার নিচ্ছে এবং এর মাধ্যমে নতুন ডিসি নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। তবে, এই পরিস্থিতিতে ডিসি পদে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে এবং বিশেষ করে আগামী নির্বাচনের সময়ে তাদের ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে, যা অনেক কর্মকর্তাকে ডিসি হওয়ার আগ্রহ হারানোর কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে সাবেক সচিব ও বিপিএটিসি রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ডিসি পদে নিয়োগে আগ্রহের কমতির কারণ হলো, নির্বাচনের সময়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে পদটি বিতর্কিত হয়ে পড়েছে।