আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্কদের সাথে প্রাপ্তবয়স্কদের সম্পর্ক গড়ার ঘটনা বেশ আলোচনা সৃষ্টি করছে। অনেক সময় এমন সম্পর্কের পরিণতি হয় প্রেম, বিয়ে কিংবা প্রতারণায়, যা গণমাধ্যমে বারবার শোনা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের ‘প্রেমের সম্পর্ক’।
সম্প্রতি বাংলাদেশে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে, যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে ১১ বছর বয়সী একটি মেয়ে নিখোঁজ হয়। প্রথমদিকে অনেকেই ধারণা করেছিলেন, মেয়েটি হয়তো বিপদে পড়েছে। তবে ৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ জানায়, মেয়েটি ‘স্বেচ্ছায়’ তার কথিত প্রেমিকের সঙ্গে নওগাঁ চলে গিয়েছিল। মেয়েটির সঙ্গে তার পরিচয় ছিল টিকটক থেকে, দুই বছর আগে। তখন মেয়েটির বয়স ছিল ৯ বছর এবং ছেলেটির বয়স ছিল ১৯।
এ ঘটনা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন—এ ধরনের সম্পর্ক গড়ার আইনি অবস্থান কী? বর্তমানে বাংলাদেশে এই ধরনের সম্পর্কের বিরুদ্ধে কী ধরনের আইনি বাধা আছে?
আইনি বাধা
এই ধরনের ঘটনার বিচার ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’ এবং ‘শিশু আইন, ২০১৩’ অনুযায়ী করা হয়। যদি কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ১৪ বছরের কম বয়সী ছেলে বা ১৬ বছরের কম বয়সী মেয়েকে তার অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া প্রলোভন দেখিয়ে বা জোর করে নিয়ে যায়, তাহলে তা শিশু অপহরণের শামিল। এই ক্ষেত্রে, মোহাম্মদপুরের ওই মেয়েটি যদি ‘স্বেচ্ছায়’ চলে গিয়েও থাকে, আইন অনুযায়ী সেটি অপহরণ হিসেবে গণ্য হবে।
এছাড়া ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে’ বলা হয়েছে, কেউ যদি কোনো নারী বা শিশুকে অপহরণ করে অপরাধের উদ্দেশ্যে নয়, তবে তাকে যাবজ্জীবন বা কমপক্ষে ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাওজিয়া করিম বলেন, “এ ধরনের সম্পর্ক স্থাপন বা জোরপূর্বক সম্পর্ক গড়লে তা আইনত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। যদি অপ্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয়, তবে সেটি ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে।”
আইনের ফাঁক
এই ধরনের ঘটনায় আইনের কিছু ফাঁকও রয়েছে, যা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মোহাম্মদপুরের ওই ঘটনার পর। একজন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিতি সানজানা বলেন, “১১ বছরের শিশু নিজের সম্মতি দিতে সক্ষম নয়। যদি সে কোন কারণে সম্মতিও দেয়, তবে আইনে তার সেই সম্মতি অগ্রাহ্য। এতে বিষয়টি স্পষ্টভাবে অপহরণ হিসেবেই গণ্য হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এমনকি ১৬ বছরের কম বয়সী মেয়েদের সঙ্গে বিয়ের পর যদি শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয়, তা ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে।”
সমাজের অবস্থা
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপ্রত্যাশিত ব্যবহার শিশুদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এই সমস্যা থেকে বাঁচাতে পরিবার এবং সমাজের দায়িত্ব বেড়ে যাচ্ছে। আইনজীবী ফাওজিয়া করিম বলেন, “এ ধরনের ঘটনায় বাবা-মায়ের সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সদস্যরা যদি পরস্পরের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা করতেন, তাহলে হয়তো এই ধরনের ঘটনা ঘটতো না।”
অন্যান্য দেশের উদ্যোগ
বিশ্বের অন্যান্য দেশেও শিশুদের সুরক্ষার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালে অস্ট্রেলিয়া ১৬ বছরের কম বয়সীদের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা পৃথিবীর কঠোরতম আইন হিসেবে বিবেচিত হয়। ফ্রান্সও ১৫ বছরের কম বয়সীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের জন্য বাবা-মায়ের অনুমতি বাধ্যতামূলক করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ অঙ্গরাজ্যেও এ ধরনের আইন প্রণীত হয়েছিল, যদিও পরে তা বাতিল হয়।
এছাড়া নরওয়ে এবং যুক্তরাজ্যও এ ধরনের আইন প্রণয়নের চিন্তা করছে।
শেষ কথা
এ ধরনের ঘটনা সমাজে অব্যাহতভাবে বাড়ছে, এবং এর জন্য আইনি ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। শিশুদের সুরক্ষায় কঠোর আইন এবং পরিবার, স্কুল ও কমিউনিটি স্তরে সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি।