বর্তমানে বায়ুদূষণ এমন এক ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, আমাদের ঘরের ভেতরেও আর নিরাপদ থাকা যাচ্ছে না। তবে অনেকেই ঘরের বাতাসের মান নিয়ে তেমন একটা উদ্বিগ্ন হন না, যা আসলে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এমনকি অফিস বা আদালতেও অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মানুষের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। তাই সুস্থ থাকতে চাইলে এর প্রতিরোধ অত্যন্ত জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানুষ বেশি সময় ধরে বাড়ির ভেতরেই বায়ুদূষণের শিকার হন। অ্যানার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, বাইরের পরিবেশের তুলনায় বাড়ির ভেতরের বায়ুদূষণের মাত্রা দুই থেকে পাঁচ গুণ বেশি। অথচ আমাদের ঘর হওয়া উচিত সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক সাম্প্রতিক রিপোর্টে জানা গেছে, প্রতিবছর প্রায় ৩০ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণের কারণে অকাল মৃত্যুবরণ করেন, এর মধ্যে প্রায় ২ লাখ শিশু, যাদের বয়স ৫ বছরের নিচে। এর মধ্যে ৩২% হৃদরোগ, ২৩% স্ট্রোক, ২১% শ্বাসনালির সংক্রমণ এবং ১৯% ক্রনিক ফুসফুসজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
আইকিউএয়ারের মানসূচকে ঢাকার গড় বায়ুর মান ১৭০, যা ভয়াবহ অস্বাস্থ্যকর বলে চিহ্নিত হয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বায়ুদূষণের হার গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল, আর গত বছরের জানুয়ারি মাসে দূষণের মাত্রাও ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণের কারণে মারা যান।
অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের অভাব, নিম্নমানের রং ও নির্মাণ সামগ্রী, বাহ্যিক দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন। এছাড়া, গাড়ির ধোঁয়া, রাস্তার ধুলাবালি এবং গ্যাসের চুলা থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডও ঘরের বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও ছত্রাকের বৃদ্ধি আরেকটি বড় কারণ।
অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণের কারণে যে সকল স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে, সেগুলো হলো:
- শিশুদের ফুসফুসের বিকাশে সমস্যা
- দীর্ঘ মেয়াদে ফুসফুসের কার্যকারিতা হ্রাস
- অ্যালার্জি, চোখের জ্বালা, মাথাব্যথা এবং ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা
- ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি
তাহলে, এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কী? কীভাবে ঘরের বাতাস বিশুদ্ধ রাখা যায়? এটি খুব কঠিন কিছু নয়, কিছু সহজ পদক্ষেপ নিলেই ঘরের বাতাসকে দূষণমুক্ত রাখা সম্ভব।
১. নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
ঘরের পরিবেশে ধুলা, ময়লা ও ছত্রাক জমে না থাকতে দেয়ার জন্য নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জানালা ও দরজার পর্দা, বিছানার চাদর এবং কার্পেট নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে, না হলে এসব জায়গায় জমতে থাকে ধুলা এবং ময়লা, যা ঘরের পরিবেশকে অস্বাস্থ্যকর করে তোলে।
২. পর্যাপ্ত আলো ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা
ঘরের ভেতর তাজা বাতাস এবং সূর্যের আলো প্রবাহিত হওয়া খুবই জরুরি। প্রতিদিন জানালা খুলে ঘরের ভেতর তাজা বাতাস প্রবাহিত হতে সাহায্য করুন। সূর্যের আলো জীবাণু ধ্বংসে কার্যকর, আর ভালো ভেন্টিলেশন বাতাসের চলাচল স্বাভাবিক করে দূষণ কমাতে সাহায্য করে।
৩. ঘরে ‘ইনডোর প্ল্যান্ট’ রাখা
কিছু ইনডোর প্ল্যান্ট যেমন স্নেক প্ল্যান্ট, পিস লিলি, অ্যালোভেরা ঘরের বাতাসের গুণগত মান উন্নত করে। এই গাছগুলো বাতাস থেকে ক্ষতিকর গ্যাস শোষণ করে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যা পরিবেশকে স্বাস্থ্যকর রাখে।
৪. রাসায়নিক উপাদানের ব্যবহার কমানো
শক্তিশালী কেমিক্যালযুক্ত এয়ার ফ্রেশনার বা ক্লিনিং প্রোডাক্টের পরিবর্তে প্রাকৃতিক উপাদান যেমন লেবু, বেকিং সোডা, নিমপাতা ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া, এসেনশিয়াল অয়েল ব্যবহার করতে পারেন, যা ঘরকে সুগন্ধিত করে এবং বায়ুর মান উন্নত করতে সাহায্য করবে।
৫. ইকো-ফ্রেন্ডলি পেইন্ট ব্যবহার
বাজারে প্রচলিত পেইন্টে থাকা ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ডস ধীরে ধীরে বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এর পরিবর্তে লো-ভিওসি, নন-টক্সিক ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ইকোফ্রেন্ডলি পেইন্ট ব্যবহার করা উচিৎ। এই পেইন্ট জলীয়ভিত্তিক এবং পরিবেশবান্ধব, তাই শিশু ও অ্যালার্জিপ্রবণ ব্যক্তিদের জন্য উপযোগী।
এই সহজ পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে আমরা ঘরের বাতাসকে দূষণমুক্ত রাখতে এবং আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারি।
আমরা যদি ঘরের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না রাখি, তাহলে আমাদের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা। তাই আমাদেরকে সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।