”ফুলবাড়িয়ার হোগলাপণ্যের বিদেশে চাহিদা বেশি”

সুজিলা খাতুন (৩০) ও তাঁর স্বামী আনোয়ার হোসেনের সংসার শুরু থেকেই কষ্টের ছিল। আনোয়ার হোসেন পেশায় ভ্যানচালক এবং তাঁদের তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হতো। সাত বছর আগে তাঁদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আে, যখন আনোয়ার হোসেন হোগলাপাতার পণ্য তৈরি শুরু করেন। দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে তিনি এই পণ্য তৈরি করে বর্তমানে মাসে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা আয় করছেন, যা তাঁদের জীবনে সচ্ছলতা নিয়ে এসেছে।

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় সুজিলা খাতুনের মতো প্রায় দুই হাজার পরিবার এই হোগলাপাতার পণ্য তৈরি করে নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করেছে। নারীরা ঘরের কাজের পাশাপাশি এই শিল্প যুক্ত হয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে, পাশাপাশি তরুণ উদ্যোক্তাদেরও সফলতা এনে দিয়েছে। গ্রামে তৈরি হওয়া এসব কারুশিল্প বাংলাদেশে তেমন চাহিদা না থাকলেও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব এই পণ্যের চাহিদা বাড়ছে।

সুজিলা খাতুনের বাড়ি ফুলবাড়িয়ার বাকতা ইউনিয়নের কৈয়ারচালা গ্রামে। এখানে অন্তত আজন উদ্যোক্তা আছেন যারা নারীদের দিয়ে হোগলাপাতার পণ্য তৈরি করে ঢাকায় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছেন। এই উদ্যোক্তারা হলেন মোজাম্মেল হোসেন, শাহ আলম, আব্বাস উদ্দিন, জামান মিয়া, আশরাফুল ইসলাম, আলমাস আলী, আনোয়ারা বেগম ও সুমন মিয়া।

আলমাস আলী (৩২) ২০০৯ সালে নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে ঢাকায় একটি হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। সেখানে কাজ করে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অভিজ্ঞ কারিগর হয়ে ওঠেন। পরে ২০১৬ সালে তিনি গ্রামে এই শিল্পের প্রসার ঘটাতে উদ্যোগ নেন। এখন তিনি বছরে প্রায় এক কোটি টাকার পণ্য তৈরি করেন।

আলমাস আলীর ছোট ভাই মোজাম্মেল হোসেন (২৮) হোগলাপাতার পণ্যের একজন সফল উদ্যোক্তা। ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভালুকজান গ্রামের জামতলী মার্কেট এলাকায় তাঁর প্রতিষ্ঠানে পণ্য তরি হয়। তিনি এখন প্রতি মাসে পাঁচ–ছয় লাখ টাকার পণ্য তৈরি করেন এবং এসব পণ্য দেশের বাইরে ১০০টির বেশি দেশে রপ্তানি করা হয়। বিশেষ করে ইউরোপে এর চাহিদা বেশি।

মোজাম্মেল হোসেন জানান, এসব পণ্য তৈরির জন্য হোগলাপাতা নোয়াখালী থেকে আনা হয় এবং গ্রামে নারীদের দেওয়া হয়। তারা বিভিন্ন পণ্য তৈরি করেন এবং সেগুলোর ফিনিশিং দেওয়ার পর ঢাকায় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হয়। তিনি বলেন, “এই পণ্য প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা পরিবেশবান্ধব।”

বাকতা ইউনিয়নের কৈয়ারচালা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঘরবাড়িতে হোগলাপাতার পণ্য তৈরি হচ্ছে। মোমেনা খাতুন (৩৫) ও সালমা আক্তার (৩২) জানান, এই কাজের মাধ্যমে তারা বাড়তি আয় করতে সক্ষম হয়েছেন এবং তাদের জীবনযাত্রা সহজ হয়েছে।

ফুলবাড়িয়া উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা রওশন জাহান বলেন, “তরুণ উদ্যোক্তারা রপ্তানিমুখী শিল্পে যুক্ত হয়ে অনেকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। তবে উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ পেলে এই শিল্প আরও বিস্তার লাভ করবে।”

জামান মিয়া (২২) হলেন আরেক তরুণ উদ্যোক্তা, যিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। তিনি এখন ১৫০ জন নারী শ্রমিককে কর্সংস্থান দিয়েছেন এবং বছরে ৫০-৬০ লাখ টাকার পণ্য তৈরির অর্ডার নিচ্ছেন। জামান বলেন, “পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আমরা জানি, কিন্তু হোগলাপাতার পণ্য পরিবেশের জন্য উপকারী।”

ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, “এই শিল্পটি বেকারত্ব দূরীকরণ এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করছে। প্রশাসন এ ধরনের শিল্পের বিকাশে সব ধরনের সহযোগিা প্রদান করবে।”

এভাবে, হোগলাপাতার পণ্য তৈরির এই উদ্যোগ শুধুমাত্র মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করছে, তা ছাড়া পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদনে অবদান রেখে চলেছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।