সাত বছর পর নাম পেল খুলনার নতুন পার্ক
খুলনায় দীর্ঘ সাত বছর পর অবশেষে নাম পেয়েছে শহরের নতুন পার্কটি। ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে এই পার্কটির নামকরণ হয় ‘খুলনা রিভারভিউ পার্ক’। এর আগে এটি বিভিন্ন নাম ঘুরে বেড়িয়েছে—‘খুলনা ডিসি পার্ক’, ‘মুক্তিযোদ্ধা পল্লী’, ‘বঙ্গবন্ধু ইকোপার্ক’, ‘শেখ রাসেল ইকোপার্ক’, ‘জেলা প্রশাসন পার্ক’, এবং ‘খুলনা ইকোপার্ক’। নামের এসব পরিবর্তনের পেছনে ছিল মূলত মালিকানা দখলের প্রচেষ্টা, যা ঘটেছিল খুলনা জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগের মধ্যে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, পার্কটি অধিকার করে নিতে নানা কৌশল অবলম্বন করেছে জেলা প্রশাসন। কখনো তারা ‘বঙ্গবন্ধু’র নাম ব্যবহার করে বিরোধীদের সরিয়ে দিয়েছে, আবার ‘ইকোপার্ক’ যুক্ত করে জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছে। এই সুযোগে বন বিভাগ পার্কটির নির্মাণকাজ শুরু করে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ২০২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর তড়িঘড়ি করে পার্কটি উদ্বোধন করা হয়, এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় বন বিভাগের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই।
সাবেক প্রকল্প পরিচালক আবু নাসের মোহসিন হোসেন জানান, বন বিভাগকে পার্কের উদ্বোধনের বিষয়ে জানানো হয়নি। তিনি জানতেন, পার্কে বিভাগীয় কমিশনার ও পুলিশ কমিশনার আসবেন, কিন্তু গিয়ে দেখেন উদ্বোধন হয়ে গেছে।
এত কিছুর পরেও পার্কটির মালিকানা নিয়ে বিতর্ক এখনও শেষ হয়নি। বন বিভাগের অধীনে থাকা পার্কটি নিয়ে জেলা প্রশাসন এবং বন বিভাগের মধ্যে চলছিল টানাহেঁচড়া। এর মধ্যে জলবায়ু তহবিলের প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যা বিশেষজ্ঞদের মতে অপচয় হয়েছে।
চিঠি দিয়ে শুরু হয়েছিল পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ
২০১৬ সালের মে মাসে খুলনা বিভাগের প্রতিটি জেলা প্রশাসকের কাছে তৎকালীন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুস সামাদ একটি চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে খাসজমিতে ‘জেলা প্রশাসন ইকোপার্ক’ তৈরি করার আহ্বান জানানো হয়। ২০১৭ সালে জমি খুঁজে বের করে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এর মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয় এবং বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড থেকে অর্থ পাওয়া যায় পার্কের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য।
পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে বন বিভাগের সঙ্গে মালিকানার বিতর্কে
পার্ক নির্মাণের পর বন বিভাগ এবং জেলা প্রশাসন উভয়েই মালিকানা দাবি করে। ২০১৮ সালে বন বিভাগ ওই জমি তাদের আওতায় চাইলে জেলা প্রশাসক মো. আমিন উল আহসান চিঠি দিয়ে জানান, এটি এককভাবে বন বিভাগের হাতে হস্তান্তর করা সম্ভব নয়। এরপর থেকে নামকরণের জটিলতা শুরু হয়, যা একের পর এক পরিবর্তিত হয়। কখনো ‘খুলনা ডিসি পার্ক’, কখনো ‘বঙ্গবন্ধু ইকোপার্ক’, এরপর ‘শেখ রাসেল ইকোপার্ক’ এবং শেষপর্যন্ত ‘খুলনা রিভারভিউ পার্ক’ নামকরণ হয়।
জলবায়ু তহবিলের অপব্যয় এবং গাছের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন
পার্কের উন্নয়ন কার্যক্রমে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল থেকে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই টাকা মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহায়তার জন্য ব্যবহৃত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা ব্যবহার করা হয়েছে একটি পার্ক তৈরির জন্য। গাছের সংখ্যা ও প্রকৃত খরচ নিয়ে বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের রিপোর্টে অসঙ্গতি দেখা গেছে।
তবে পার্কটির অবকাঠামো ও গাছ লাগানোর পরিকল্পনা একেবারে আলাদা ছিল। মাছ ধরার জোন, সুইমিংপুল, ঝুলন্ত ব্রিজ, ওয়াটার ব্রিজ, খেলাধুলার মাঠ, খাবারের জায়গা—এসব নির্মাণের জন্য জলবায়ু তহবিলের অর্থ ব্যবহার করা হয়েছিল, যা পরিবেশ বিষয়ক আইনবিদদের মতে, ‘অপব্যয়’ এবং ‘অন্যায়’।
শেষে নাম পেল ‘খুলনা রিভারভিউ পার্ক’
সবশেষে, নামের সঙ্গে যুক্ত বিতর্কের পর ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে পার্কটির নামকরণ হয় ‘খুলনা রিভারভিউ পার্ক’। তবে এখনও পার্কটির মালিকানা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি, এবং ভবিষ্যতেও এ বিষয়ে বিতর্ক চলতে পারে।