হঠাৎই যেন রাজনীতির মঞ্চে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। পুরনো বন্ধুদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিচ্ছে এবং শত্রুদের দিকে মনোযোগ বাড়ছে। ক্ষমতার যুদ্ধে তেমন কিছু নতুন নয়—এটা সবসময়ই কঠিন এবং নিষ্ঠুর। বর্তমান রাজনীতি দেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব থেকে সরে আসার পর পরিস্থিতি বেশ পরিবর্তিত হয়েছে। একে অপরের কাছাকাছি চলে আসছে পুরনো শত্রুরা, এবং এখন দুটি বড় প্রশ্ন সামনে—এক. আগামী নির্বাচন কবে হবে? দুই. নির্বাচনে কারা জয়ী হবে?
এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন রাজনৈতিক দলের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। একথা সত্যি যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম হয়নি। সামরিক-নাগরিক, তন্ত্র-তত্ত্ব, বিভিন্ন মতাদর্শের মধ্যে বৈচিত্র্য ছিল। তবে, অধিকাংশ নতুন দলই তেমন সফলতা পায়নি, দল আসে, দল যায়, আর এই নিয়ম চলতে থাকে।
তবে, এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কথা অনেকেই শুনছেন, জন্মের আগেই নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। বিএনপি নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যে একটি বিশেষ বিষয় উঠে এসেছে। কেউ কেউ জামায়াত-শিবিরের তীব্র সমালোচনা করছেন, আবার নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগের নেতাদের নিয়েও কিছু বক্তব্য উঠে আসছে। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে কিছুটা নাটকীয়তা তৈরি হয়েছে। এই সবই রাজনীতির অংশ, আর এজন্যই বিএনপি এতটা রিঅ্যাক্ট করছে। বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী উল্লেখ করেন, “রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।” বিএনপি নেতারা সোশ্যাল মিডিয়ায় এই নতুন উদ্যোগকে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে অভিহিত করছেন। তবে নাগরিক কমিটির সমর্থকরাও তাদের পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। একটি শীর্ষ নেতা মন্তব্য করেন, “বাংলাদেশের প্রথম কিংস পার্টি বিএনপি।”
বিএনপি’র একাংশ মনে করছে, এই নতুন উদ্যোগের পেছনে জামায়াতের সমর্থন রয়েছে। এতে দলটির মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নির্বাচন কবে হবে এবং তা নিয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে নানা প্রশ্ন উঠছে। প্রধান উপদেষ্টা কিছুটা সময়সীমা দিলেও, তা বিএনপির মধ্যে শিথিলতা সৃষ্টি করতে পারেনি। এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি সরকারবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করবে? কিছু সূত্র দাবি করছে, আওয়ামী লীগ পরিস্থিতি বদলানোর চেষ্টা করবে, এবং বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে পারে।
এ অবস্থায়, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের নেতাদের নেতৃত্বে নতুন দলের গঠন বিষয়ে তৎপরতা চলছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে দলটি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটির ব্যানারে বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি গঠন শুরু হয়েছে, এবং ৩৬ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিও গঠিত হয়েছে। তবে কিছু শীর্ষ সমন্বয়করা ভিন্নমত পোষণ করছেন।
এমন পরিস্থিতিতে, নতুন রাজনৈতিক দল কেন গঠন করা হচ্ছে? একাধিক সূত্রের মতে, ছাত্রদের শক্তিশালী অংশগ্রহণের কারণেই এই উদ্যোগ। তারা বিশ্বাস করেন, ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তন সম্ভব। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে ভারতের বিরোধিতার ভূমিকা ছিল দৃঢ়, আর এই আন্দোলনের নেতৃত্বও প্রায়শই ভারতের নানা অবস্থানকে সমালোচনা করেছিল। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, আওয়ামী লীগের ভূমিকা ভবিষ্যতে কী হবে, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। আওয়ামী লীগের সদ্য প্রকাশিত বিবৃতিতে ছাত্রনেতাদের “সন্ত্রাসী” বলে অভিহিত করা হয়েছে, যা রাজনৈতিক পরিবেশকে আরও জটিল করছে।
নতুন দল গঠনের সমর্থকরা বলছেন, দেশের জনগণের মধ্যে এক নতুন রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রয়েছে, এবং তারা মনে করেন, এই নতুন দল দেশ ও সমাজের জন্য কিছু ভালো করতে পারে। নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আকতার হোসেন বলেছেন, তারা নির্বাচন নিয়ে সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নেবেন, তবে এখন তারা দল গঠনের দিকে মনোযোগী।
তবে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা জানিয়েছেন, তাদের সংগঠন রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য নয়, এটি একটি গণ-অভ্যুত্থানের প্ল্যাটফর্ম। যারা রাজনৈতিক দল গঠন করতে চান, তাদের আন্দোলনের অংশ হিসেবে থাকতে হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারি বলেন, রাজনৈতিক দল গঠন করার অধিকার সবার রয়েছে, তবে সফলতা কতটা হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন। তিনি মনে করেন, ছাত্রদের যদি একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে হয়, তবে তাদেরকে তাদের কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে হবে।
অবশ্যই, পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ এবং রাজনৈতিক দৃশ্যপটে নানা সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, যেখানে ছাত্রদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।