“জগতে কোনো কাজ ঘটে না কারণ ছাড়া। যেখানে কাজ আছে, সেখানে কাজের কারণ আছে।” কাজ ও কারণ মূলত দুটি ঘটনা: যেখানে একটি ঘটনার ফলে অন্য একটি ঘটনা ঘটে। প্রথম ঘটনাটি কারণ এবং এর ফলে ঘটে যাওয়া ঘটনা কাজ। যেমন, বৃষ্টি হলে মাটি ভিজে যায়—এখানে বৃষ্টি কারণ এবং মাটি ভেজা কাজ। প্রাচীন দার্শনিকরা বলতেন, কার্য-কারণ সম্পর্ক অবশ্যম্ভাবী এবং অনিবার্য। তবে একটি কাজ একমাত্র একটি কারণেই ঘটে, একাধিক কারণ থাকতে পারে না।
ইমাম আবু হামিদ গাজালি (১০৫৭-১১১১) এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেন। তিনি দেখান, কার্য-কারণ সম্পর্ক কোনোভাবে অনিবার্য নয়। এগুলোর মধ্যে শুধু পূর্বাপর সম্পর্ক রয়েছে, যা একটি ঘটনা অন্য ঘটনার পরে ঘটে বা ঘটানোর জন্য। গাজালি বলেন, প্রাকৃতিক ঘটনা বা বস্তুগুলো একে অপরের কারণ হতে পারে না, বরং তাদের সম্পর্ক সম্ভাব্যতার ওপর ভিত্তি করে। খাদ্যগ্রহণ এবং ক্ষুধা নিবারণ, আঘাত এবং ব্যথা—এগুলো প্রাকৃতিক ঘটনা, কিন্তু এগুলোর মধ্যে কোনো অনিবার্য সম্পর্ক নেই। প্রকৃত কারণ হল আল্লাহ, যার ইচ্ছা অনুযায়ী এসব ঘটনা ঘটে।
গাজালি প্রাকৃতিক নিয়মে কার্য-কারণ সম্পর্কের ধারণা প্রদান করেন, যেখানে একটি ঘটনা পূর্বে ঘটলে পরবর্তী ঘটনা ঘটে। এই নিয়মের মধ্যেই আমাদের অভিজ্ঞতা, ধারণা এবং জ্ঞান তৈরি হয়। তার মতে, প্রাকৃতিক বস্তু বা নভোমণ্ডলীয় সত্তা কোনোভাবে একে অপরের কারণ হতে পারে না, কারণ তারা নিজেদের নিয়ম এবং গতির মাধ্যমে কার্য-কারণ সম্পর্ক গড়ে তোলে।
গাজালি প্লেটোনিক বিকিরণবাদের ভুলও প্রমাণ করেন, যেখানে দার্শনিকরা একক কারণের জন্য একটিমাত্র কার্য খুঁজে পেতেন। তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে অনেক শর্ত ও কারণ একসাথে কাজ করে, এবং কিছু কারণ আমাদের উপলব্ধির বাইরে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, কোনো একটি ঘটনা একক কারণে ঘটে না, বরং অনেক কারণের সম্মিলিত প্রভাবেই ঘটে।
গাজালি বিশ্বাস করেন, প্রকৃতিতে পূর্বাপর সম্পর্কের কোনো শুদ্ধতা বা অনিবার্যতা নেই, তবে ঘটনা গুলো সুশৃঙ্খলভাবে ঘটতে থাকে। এই সম্পর্কটি কারণিক সংযোগের মাধ্যমে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছায়, যা কোনো এক উৎস বা প্রাথমিক কারণের দিকে এগিয়ে যায়। গাজালির মতে, এই আদি কারণই সব কারণের স্রষ্টা, যা কোনো শর্ত বা ফলাফলের ঊর্ধ্বে।
ডেভিড হিউম (১৭১১-১৭৭৬) এবং তার পূর্ববর্তী জন লক (১৬৩২-১৭০৪) প্রাচীন গ্রিক চিন্তাধারার অনুগামী হলেও, হিউম পরবর্তীতে স্বীকার করেন যে কার্য-কারণের মধ্যে অনিবার্য সম্পর্ক নেই। তার মতে, সত্যিকারের জ্ঞান আসে সংবেদন ও ধারণার মাধ্যমে, এবং শর্তমতো বা বিশ্লেষণ করে এক ঘটনা আরেকটির কারণ হতে পারে না। হিউমও বলেন যে, একটি কারণ একাধিক হতে পারে, এবং কার্য-কারণের মধ্যে সম্পর্ক কেবল অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বোঝা যায়।
হিউমের মতবাদ গাজালির কার্য-কারণ তত্ত্বের ধারাবাহিকতা, যেখানে কার্য-কারণের মধ্যে নির্দিষ্ট সম্পর্কের অস্বীকৃতি গাজালি একাদশ শতকে ঘোষণা করেছিলেন এবং হিউম সেই ধারণাকে পরবর্তী সময়ে প্রকাশ করেন।
ফরাসি দার্শনিক আর্নেস্ট রেনান (১৮২৩-১৮৯২) বলেন, “গাজালি যা বলেছেন, তার ওপর হিউম নতুন কিছু বলেননি।” কেবল হিউম নয়, গাজালির কার্য-কারণ তত্ত্বের প্রভাব ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলেও প্রতিফলিত হয়েছে। আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনের অন্যতম প্রভাবশালী চিন্তাবিদ ইমানুয়েল কান্টের দর্শনেও গাজালির প্রভাব দেখা যায়।
কান্টের ‘ক্রিটিক অব পিউর রিজন’-এ তিনি অভিজ্ঞতাবাদ এবং যুক্তিবাদের সমালোচনা করেন। তার মতে, মানুষের জ্ঞান শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা বা যুক্তি থেকে আসে না, বরং এটি সর্বজনীন এবং প্রয়োজনীয়। কান্টের মতে, স্থান এবং সময় আমাদের অন্তর্দৃষ্টি থেকে উদ্ভূত, বাহ্যিক বস্তু থেকে নয়। মনের মধ্যেই কর্ম-কারণ এবং পদার্থ ইত্যাদি আরোপিত হয়, যা আমাদের জ্ঞান তৈরি করে।
কান্টের এই বিশ্লেষণ গাজালির দর্শনের ধারাবাহিকতায়। গাজালি তার ‘তাহাফুতুল ফালাসিফা’ (দার্শনিকদের পরস্পরবিরোধ) গ্রন্থে জ্ঞান এবং সংশয় সম্পর্কে আলোচনায় যথেষ্ট গভীরতা দিয়েছেন। তিনি গ্রিক দর্শন এবং তার সমকালীন দার্শনিকদের সমালোচনা করেন, যারা অভিজ্ঞতা এবং যুক্তির ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল ছিলেন।
গাজালি বিশ্বাস করতেন, জ্ঞান অর্জনের জন্য একমাত্র আল্লাহর কাছে ঈশ্বরীসঙ্গতা এবং অনুপ্রেরণা (ইলহাম) গুরুত্বপূর্ণ। যদিও কান্ট এই তত্ত্বে কিছুটা আলাদা পথে গিয়েছেন, তিনি গাজালির সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের ধারায় চলেছেন।
গাজালি প্রাচীন মুসলিম দর্শনকে সমৃদ্ধ করেছেন, যদিও পরবর্তী মুসলিম দর্শন তার তত্ত্বের সুফল পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি। তার ‘বিশুদ্ধ ইচ্ছা’ (নিয়ত) ও নিষ্ঠা (ইখলাস) এর মতো নৈতিক ধারণাগুলি কান্টের “সদিচ্ছা” তত্ত্বের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।
গাজালির দর্শন শতাব্দী ধরে পশ্চিমা দর্শনকে প্রভাবিত করেছে। তার কাজের উপাদান ইউরোপীয় দার্শনিকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে, যেমন টমাস একুইনাস এবং অন্যান্য চিন্তাবিদরা। গাজালি তার সময়ের অনেক আগেই আধুনিক দর্শনের ধারণাগুলোর ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক এবং সক্রিয়।