কলেজে এক চাকমা বান্ধবীর মাধ্যমে খাগড়াছড়ি জেলার তার বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে গিয়ে চাকমাদের জীবনযাত্রা, সমাজ ব্যবস্থা, রীতিনীতি, খাদ্যাভ্যাস, উৎসব ইত্যাদি দেখে আমি একেবারেই বিস্মিত হয়েছি। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিল চাকমাদের মধ্যে এখনও রাজা-রাজ্য ব্যবস্থার প্রচলন। এটি দেখে আমার মনে হয়েছে, তারা যে সহজ-সরল এবং প্রাকৃত জীবনযাপন করে, তা সত্যিই অনন্য।
চাকমারা নিজেদের মধ্যে “চাঙমা” বলে পরিচিত। বিভিন্ন উপজাতি বা নৃ-গোষ্ঠী তাদেরকে বিভিন্ন নামে ডাকে। বাংলাদেশে প্রধানত তিন পার্বত্য জেলা—রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়িতে চাকমা সম্প্রদায়ের বসবাস। তবে বর্তমানে জীবিকার প্রয়োজনে সারা দেশে চাকমারা ছড়িয়ে পড়েছে। চাকমা সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রায় ৩২টি গুথি বা গোত্র এবং গঝা বা গোষ্ঠী রয়েছে।
চাকমা সমাজ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা অনুসরণ করে। আগের যুগে গর্ভবতী মহিলাকে নিজের স্বামীর ঘর বা স্বামীর গোত্রের বাড়িতে সন্তান প্রসব করতে হত, আর গর্ভবতী মহিলাদের সন্তান প্রসবের দায়িত্ব ছিল “ওঝারা” নামে পরিচিত ধাত্রীদের। তবে এখন এই প্রথা বদলেছে। চাকমা সমাজে তাদের প্রধানকে রাজা বলে অভিহিত করা হয়। রাজা তাঁদের প্রথা, রীতি, ভূমি, রাজস্ব, পার্বত্য জেলা পরিষদ অধিবেশনে অংশগ্রহণ এবং কার্বারী (গ্রামের প্রধান) ও হেডম্যান নিয়োগের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। গ্রামের কার্বারী ঝগড়া-বিবাদ এবং নানা সমস্যা সমাধান করেন, আর হেডম্যানের প্রধান কাজ হল খাজনা সংগ্রহ করা। চাকমা সম্প্রদায় আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমল থেকেই চলে আসছে। বর্তমানে চাকমা রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দেবা-শীষ রায়।
যখন আমি খাগড়াছড়ি গিয়েছিলাম, তখন সেখানকার উৎসবের সময় ছিল। যথেষ্ট জামা-কাপড় নিয়ে যাওয়ার পরেও তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক আমাকে এতটাই আকৃষ্ট করেছিল যে, আমি নিজের পোশাক ছেড়ে তাদের মতো পোশাক পরেছিলাম। চাকমা নারীরা “বেপন” নামের কোমরবন্ধ কাপড় তৈরি করেন, যা অত্যন্ত সুন্দর ও হাতে তৈরি। তাদের পোশাকের মধ্যে রয়েছে পিনন, খাদি ব, কাগই, পাগড়ি, আলাম—যেগুলোর মধ্যে আলাম এক ধরনের ফুলে বোনা কাপড়। আকর্ষণীয় এক দিক হলো, চাকমা নারীরা হাতির দাঁতের তৈরি গহনা পরেন, এবং নাকে বেশ বড় আকারের নোলক বা নাকফুল পরতে দেখা যায়।
চাকমাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তাদের বেশিরভাগ তৈজসপত্র কাঠ বা বাঁশ দিয়ে তৈরি। তাদের এক ধরনের খাদ্য হল “কেবাং”, যা কলাপাতা বা আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করা হয়। আর “গাঙ” নামে এক ধরনের খাবারও তারা বাঁশ দিয়ে প্রস্তুত করে। চাকমারা শুটকি মাছ এবং চিংড়ি মাছ খুব পছন্দ করেন। এছাড়া, লবণ, মরিচ ও হলুদ দিয়ে মাংস পুড়িয়ে “সিক্যা” নামে একটি বিশেষ খাবার তৈরি করেন। আমি সমস্ত খাবার একটু একটু করে খেয়ে দেখার চেষ্টা করেছিলাম, এবং কিছু খাবার সত্যিই বেশ সুস্বাদু ছিল।
একটা মজার বিষয় হলো, চাকমারা ভুত-প্রেতের ব্যাপারে বিশ্বাসী। তারা বিশ্বাস করে যে, কিছু অতিপ্রাকৃত শক্তি তাদের জীবনে প্রভাব ফেলে। চাকমাদের অধিকাংশই মাচা (উঁচু কাঠামোর) উপর তৈরি বাড়িতে বসবাস করেন, যা দেখতে খুবই অনন্য। যদিও মাটির বাড়িও রয়েছে তাদের মধ্যে। চাকমারা নিজেদের মধ্যে তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে, যা আমি ৪ দিন থাকার পরেও শিখে উঠতে পারিনি। তাদের নিজস্ব পাণ্ডুলিপিও রয়েছে, যা তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে।
সামগ্রিকভাবে, চাকমা সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা একটি বিশেষ ধরনের সাদাসিধে ও ঐতিহ্যপূর্ণ জীবনধারা যা আধুনিক সমাজের পাশাপাশিও তার নিজস্ব রীতিনীতি, বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে।