বাঙালি নারীর পোশাক এবং ফ্যাশন সচেতনতা
বাঙালি নারীর পোশাক বা ফ্যাশন সচেতনতা নিয়ে অনেক কিছুই বলা হয়েছে, তবে ইতিহাসের দিকে না গিয়ে শুধু কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা যাক। বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালে পৃথিবী থেকে চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর শাড়ি পরিহিত অবয়ব এখনও বাঙালির দৃশ্যপটে জীবন্ত হয়ে আছে। বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামের আরেক সাহসী নারী বেগম সুফিয়া কামাল, যাঁকেও শাড়ি পরিহিত অবস্থায় বাঙালি জাতি ভুলতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আওয়াজ তুলেছিলেন জননী জাহানারা ইমাম—তিনি আরেকজন, যাঁর শাড়ি পরিহিত অবয়ব আজও বাঙালির স্মৃতিতে অমলিন।
শাড়ি, বাঙালির প্রিয়, রুচিশীল ও মার্জিত পোশাক—এর এক বিশেষ জায়গা ইতিহাসে রয়েছে। বিচিত্র রঙ এবং ঢঙের শাড়ি, তার বিভিন্ন রীতির পরিধান ইতিহাসের পাতায় সজীবভাবে আঁকা আছে। তবে, ব্রিটিশ শাসনকালে বাঙালি নারীরা সালোয়ার-কামিজও পরতেন, যা পরবর্তীতে এক গুরুত্বপূর্ণ পোশাক হিসেবে বিকশিত হয়।
বাঙালি নারীর প্রিয় পোশাক কী, এ প্রশ্নের উত্তর একেবারে সহজ নয়। এই পোশাকটি নানা বর্ণ ও গোত্র থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছে। তাই বাঙালি নারীর পোশাক একমাত্র কোনো একটি গণ্ডিতে বাঁধা পড়তে পারে না। গত ৩০-৩৫ বছরে বাঙালি নারীর ফ্যাশন সচেতনতা অনেক বেড়েছে। শাড়ি এবং সালোয়ার-কামিজের পাশাপাশি, পশ্চিমা পোশাকেও তারা আরামদায়ক হয়ে উঠেছে। যদিও তারা পশ্চিমা নারীদের মতো অত ছোট পোশাক পরেন না, তবুও জিন্স ও টিশার্টের মতো পোশাক এখন জনপ্রিয়। ফ্যাশনের ধারা পরিবর্তনশীল—থ্রি-পিস পোশাকের জায়গায় টু-পিস জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, এবং বাঙালি নারীরা বিভিন্ন দেশের পোশাকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছে। তবে শাড়ির আবেদন আজও কমেনি, বরং একই সঙ্গে হিজাবের প্রতি আগ্রহও বৃদ্ধি পেয়েছে। পূর্বে বয়স্ক নারীদের মধ্যে বোরকা পরার প্রচলন থাকলেও, বর্তমানে যুবতী নারীদের মধ্যে হিজাব পরার প্রবণতা বেড়েছে।
ফ্যাশন সচেতনতার ক্ষেত্রে বাঙালি নারীদের মধ্যে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। শহরাঞ্চলে জিন্স ও টিশার্টের মতো পোশাক জনপ্রিয়, আবার গ্রামের কিংবা শহরতলির অঞ্চলে হিজাবের গ্রহণযোগ্যতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের প্রসাধনী পণ্যের বিজ্ঞাপনেও হিজাব পরিহিত মডেলদের ব্যবহার করছে।
আমাদের সময়ে, যখন পৃথিবী ছোট হয়ে এসেছে, প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের যে কোন প্রান্তের ফ্যাশন খুব সহজেই চলে আসে। দিল্লি বা প্যারিসের ফ্যাশনের খবর এখন ঢাকার মেয়েদের কাছে পৌঁছায় দ্রুত। পোশাক এবং ফ্যাশন একটি দেশের আবহাওয়া, পরিবেশ ও প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে, সব ধরনের পোশাক সব অঞ্চলের মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়তা লাভ করে না। এবং জীবন ও পোশাকের বিবর্তনশীলতা, ঠিক যেমন মানুষের, তেমনি বাঙালি নারীদেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মানুষ কেন পোশাক পরেন? প্রধানত, শরীরের কিছু অংশ ঢেকে রাখার জন্য এবং নিজেকে সুন্দর ও আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনের জন্য পোশাক পরা হয়। এছাড়া, মানুষের পোশাক নির্বাচনের পিছনে একটি বড় উদ্দেশ্য থাকে—অন্যের চোখে সুন্দর ও আকর্ষণীয় দেখানোর চেষ্টা। রূপচর্চাও এই উদ্দেশ্যেই করা হয়। পোশাকের নির্বাচনে শুধুমাত্র নিজের ভালো লাগাই মুখ্য নয়, বরং অন্যরা কেমন দেখবে, তা গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্প, সাহিত্য বা কবিতার মধ্যে নারীর সৌন্দর্য বর্ণিত হয়েছে। নারী যে পোশাক পরবেন, তা তাদের ব্যক্তিগত রুচি নির্ধারণ করে। তবে, কে কেমন পোশাকে সুন্দর বা আকর্ষণীয় লাগে, সেটি একজন শিল্পী, সাহিত্যিক বা কবি প্রকাশ করতে পারেন। দেহের বর্ণনা, নারীর বা পুরুষের পোশাকের উপর বিবরণ—এ সবই শিল্পের অঙ্গ।
ফ্যাশন, সৌন্দর্য বা পোশাক নিয়ে বিভিন্ন মত থাকতে পারে, তবে চরিত্রহনন বা বিষেদগার কোনোভাবে আধুনিক চিন্তা ও ফ্যাশনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বাঙালি নারীর ফ্যাশন সচেতনতা সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এগিয়ে যাচ্ছে, এবং আমরা আশা করি, এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।