বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছেন, কিন্তু ঘুম আসছে না? অথবা মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে আর চোখের পাতা এক হচ্ছে না?
অনিদ্রা বা নিদ্রাহীনতা একটি সাধারণ সমস্যা যা অনেকেই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে উঠতে পারে।
অনিদ্রার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে—বার্ধক্য, রাতে বারবার প্রস্রাবের জন্য ওঠা, মেনোপজ বা রজোনিবৃত্তি, অথবা রাতের পালা কাজ এসবের মধ্যে অন্যতম। এই সমস্যা হলে চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া জরুরি।
অনিদ্রা নিরসনে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. ফেইথ অর্চার্ড বলেন, “যখন আমি ঘুমাতে পারি না, তখন বুঝি আমার মস্তিষ্ক হয়তো বিরক্ত বা খুব দুশ্চিন্তা করছে। তখন আমি একটি বই পড়া শুরু করি, যতক্ষণ না আমি কিছুটা হালকা অনুভব করি।”
লন্ডনের রয়াল ব্রম্পটন হাসপাতালের স্লিপ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ড. অ্যালি হায়ার বলেন, “যখনই আমি অনিদ্রায় ভুগি, তখন এর কারণ আমার স্বামী বিছানায় বারবার পাশ ফেরানো বা জোরে নাক ডাকা। সেক্ষেত্রে আমি স্লিপ ডিভোর্স পদ্ধতি গ্রহণ করি, অর্থাৎ অন্য একটি ঘরে চলে যাই।”
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কলিন ইসপি বলেন, “যখন ঘুম আসেনা, তখন আমি বিছানা ছেড়ে উঠে অন্য কোথাও কিছু সময় কাটিয়ে আবার বিছানায় ফিরি। এটা একটা রিবুট সিস্টেমের মতো কাজ করে।”
অনিদ্রার উপসর্গ
ড. ইসপি বলেন, “যদি ঘুম না আসার সমস্যা এক রাতের পর কয়েক দিন ধরে চলে এবং তা পরবর্তীতে কয়েক সপ্তাহে গড়িয়ে যায়, তাহলে আমরা এটিকে অনিদ্রা বলি।”
ড. অর্চার্ড আরও যোগ করেন, “প্রাথমিকভাবে ঘুম না আসা হলেও মাঝরাতে জেগে থাকা, একবার ঘুম ভেঙে আর না ঘুমানো, অথবা ভোর পর্যন্ত ঘুম না আসা—এসবও অনিদ্রার উপসর্গ হতে পারে।”
অনিদ্রার কারণ
অনিদ্রার পেছনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া কাজ করে: এক, শরীরের চাপ এবং দুই, ঘুমে ঢোকার জন্য প্রয়োজনীয় হরমোনের প্রক্রিয়া। এসবের মধ্যে কোনো একটির সমস্যা হলে ঘুমের সমস্যা হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, দিনের বেলায় বা বিকেলে এক দফা ঘুমালে রাতে ঘুমানো কঠিন হতে পারে।
দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগও ঘুমের জন্য বড় বাধা হতে পারে। ড. ইসপি বলেন, “মানুষের মস্তিষ্ক এত বড় এবং জটিল যে, এর বিশ্রামের জন্য তুলনামূলকভাবে বেশি ঘুমের প্রয়োজন।” এই উদ্বেগ আমাদের মস্তিষ্কে এমন এক অনুভূতি সৃষ্টি করে, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জেগে থাকলেই বিপদ।
ঘুমের প্যাটার্ন ও বয়সের প্রভাব
বয়স বাড়ানোর সাথে সাথে শরীরের ঘড়ি বদলে যায়, ফলে ঘুমের প্যাটার্নও পরিবর্তিত হয়। কিশোররা রাতে দেরিতে ঘুমিয়ে দেরিতে ওঠে, কিন্তু বয়স্কদের জন্য এমনটি সম্ভব নয়। বয়স বাড়লে গভীর ঘুমের সময় কমে আসে, ফলে ঘুমে বাধা সৃষ্টি হয়।
ঘুম না আসলে কী করা উচিত?
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে কী করবেন? ড. ইসপি বলেন, “ঘুম না এলে জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করবেন না। বরং ঘুমকে স্বাভাবিকভাবে আসতে দিন।”
ড. অর্চার্ড পরামর্শ দেন, “প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে শুতে যাওয়া এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে উঠে পড়া উচিত।”
ঘুমের ওষুধের ব্যবহার
ঘুমের ওষুধ ব্যবহারের বিষয়ে ড. হেয়ার এবং অধ্যাপক ইসপি দুজনেই বিরোধী। তারা পরামর্শ দেন, কগনেটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি (CBT) ব্যবহার করার। এই থেরাপি অনিদ্রার সমস্যা অনেক ক্ষেত্রে সমাধান করতে সক্ষম এবং ৭০-৮০% মানুষের জন্য এটি কার্যকরী।
অনিদ্রার পেছনে অন্য কারণ
ড. অর্চার্ড বলেন, “স্ক্রিনে তাকানো এবং আলোও ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।” মোবাইল ফোন, টেলিভিশন, অথবা কম্পিউটার ব্যবহার করতে গেলে আলো আপনার ঘুমে প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষত যদি আপনি উত্তেজনাপূর্ণ কিছু দেখেন।
মেনোপজ, নাইট শিফট এবং এলকোহল
মেনোপজের সময় নারীদের ঘুমে অনেক সমস্যা হতে পারে। হট ফ্ল্যাশ, হরমোনের পরিবর্তন, এবং মানসিক চাপ সবই ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। এছাড়াও, এলকোহলও ঘুমের গুণমান কমিয়ে দেয়, এবং নাইট শিফটের কাজের কারণে শরীরের ঘড়ি বিঘ্নিত হয়, যা ঘুমে সমস্যা তৈরি করে।
উপসংহার
অন্তত কিছু নিয়ম মেনে চললে এবং নিজের ঘুমের অভ্যাসকে সঠিকভাবে রুটিনে আনার মাধ্যমে অনিদ্রা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।