“উড়োজাহাজে ৪০ ঘণ্টার নির্যাতন: হাতকড়া, পায়ের শিকল, শৌচাগারে টেনেহিঁচড়ে নেওয়া”

“দীর্ঘ ৪০ ঘণ্টার বিমানযাত্রা। আমাদের সবার হাতকড়া পরানো ছিল। পা ছিল শিকলে বাঁধা। আসন থেকে এক ইঞ্চিও সরতে দেওয়া হয়নি। এমনকি শৌচাগারে যেতে বারবার অনুরোধ করতে হয়। টেনেহিঁচড়ে শৌচাগারে নেওয়া হয়। শৌচাগারের দরজা খুলে ক্রুরা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঠেলে দেন।”

এই কথাগুলো বলছিলেন হরবিন্দর সিং। তাঁর বয়স ৪০ বছর, তিনি ভারতের পাঞ্জাবের হোশিয়ারপুরের তাহলি গ্রামের বাসিন্দা। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম যে ১০৪ জন নথিপত্রবিহীন অভিবাসীকে ভারত ফেরত পাঠানো হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ছিলেন হরবিন্দর।

পাঞ্জাবের অমৃতসর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ তারিখে মার্কিন সামরিক বিমানটি অবতরণ করে, যার মাধ্যমে ভারতের নথিপত্রহীন অভিবাসীরা ফিরে আসেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৪০ ঘণ্টার এই বিমানযাত্রাকে হরবিন্দর ‘নরকের চেয়েও জঘন্য’ বলে বর্ণনা করেন।

তিনি আরও জানান, এই ৪০ ঘণ্টার যাত্রা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। খেতে দেওয়ার সময়ও হাতকড়া পরেই খেতে বাধ্য করা হয়েছিল। নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে হাতকড়া খুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেও কিছুই হয়নি। এই অভিজ্ঞতা শুধু শারীরিকভাবে কষ্টকর ছিল না, মানসিকভাবে এটি ছিল অত্যন্ত ক্লান্তিকর।

তবে, একদা এক দয়ালু ক্রু সদস্য তাঁরা ফল খেতে দিয়েছিলেন, যা কিছুটা স্বস্তি নিয়ে আসে।

হরবিন্দর মাত্র আট মাস আগে ‘ডাঙ্কি রুট’ ধরে ভারতে থাকা স্ত্রীর জন্য উন্নত জীবন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তবে, দীর্ঘ বিমানযাত্রার পথে তিনি একটুও ঘুমাতে পারেননি। সারাক্ষণ শুধু স্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি মনে পড়ছিল।

হরবিন্দরের স্ত্রীর নাম কুলজিন্দর কউর। ১৩ বছরের বিবাহিত জীবনে তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। পরিবারটি কৃষিকাজ করে এবং গরুর দুধ বিক্রি করে জীবন চালানোর চেষ্টা করত। ২০২৪ সালের জুনে, কুলজিন্দর এবং হরবিন্দর একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন—এতটাই কঠিন পরিস্থিতি ছিল, তারা যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে যাওয়ার জন্য ৪২ লাখ টাকার বিনিময়ে প্রস্তাব গ্রহণ করেন।

এই টাকা সংগ্রহ করতে তাদের একমাত্র জমিটি বন্ধক রাখতে হয় এবং চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তও বিপদে ফেলে। কুলজিন্দর বলছিলেন, “হরবিন্দর আট মাস ধরে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ধাক্কা খেয়েছে। তিনি কখনোই ভালো অবস্থায় ছিলেন না।”

হরবিন্দর যখন জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি নিয়মিত তার ভিডিও তৈরি করে কুলজিন্দরকে পাঠাতেন। কুলজিন্দর বলেন, “তার সঙ্গে শেষবার কথা হয় ১৫ জানুয়ারি। এরপর আর যোগাযোগ হয়নি। যখন শুনলাম, ১০৪ জন অভিবাসী ফেরত আসছে, তাদের মধ্যে হরবিন্দরও ছিলেন, তখন সেটা ছিল এক বড় আঘাত।”

গ্রামের লোকজন তাঁকে জানায়, ৫ ফেব্রুয়ারি হরবিন্দরকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে। কুলজিন্দর গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে অভিযোগ করেন এবং ওই ট্রাভেল এজেন্টের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।

তিনি বলেন, “আমরা সবকিছু হারিয়েছি। আমাদের একমাত্র চাওয়া ছিল আমাদের সন্তানদের জন্য একটি ভালো ভবিষ্যৎ। কিন্তু এখন আমরা ঋণের ভারে ডুবে আছি এবং আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে।”

হরবিন্দরের পরিবারের পূর্বপুরুষরা কৃষিকাজ করতেন, এবং তাঁদের জন্য এটি ছিল চ্যালেঞ্জিং। এখন, হরবিন্দরের ভাই এবং বৃদ্ধ বাবা-মাও তাদের জীবন চালানোর জন্য মাঠে কাজ করছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।