বিশ্বজুড়ে পরিবেশ এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন বিপর্যয়কর গতিতে বাড়ছে, যা আমাদের জন্য সুখবর নয়। এই পরিবর্তনগুলো মূলত নেতিবাচক এবং আমাদের প্রকৃতি ও জীবিকা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিয়েছেন যে, বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৮টি দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো ব্যাপক পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন হবে। ওয়াশিংটনের আবহাওয়া ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতার বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে, যা এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে। এই পরিবর্তনের ফলে লাখ লাখ মানুষ পরিবেশগত উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। তবে তারা আশ্বস্ত করেছেন যে, উন্নত প্রযুক্তি ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।
‘স্পোর্টস ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট’ এবং ৮টি এশীয় দেশের সরকারের সহযোগিতায় পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক বন্যা, ভূমিধ্বস এবং উপকূলীয় মৎস্য উৎপাদন হ্রাস পাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান এবং ঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে মানুষ ও প্রকৃতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইন—এই ৮টি দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যা বসবাস করে এবং তারা গ্রীন হাউস প্রভাবের মারাত্মক শিকার হবে।
গ্রীন হাউস প্রভাব এবং বন উজাড়ের ভূমিকা
গ্রীন হাউস প্রভাবের প্রধান কারণ হিসেবে বন উজাড়কে চিহ্নিত করা হচ্ছে। পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় একটি দেশের ২৫% বনভূমি থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে এই পরিমাণ বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৯%। বাস্তবে, সরকারি হিসাবের চেয়ে প্রকৃত বনভূমির পরিমাণ আরও কম। বনভূমির এই অস্বাভাবিক হ্রাসের ফলে বাংলাদেশের জলবায়ু ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, যার প্রভাব ভূগর্ভস্থ পানির স্তরেও পড়ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা গত শতাব্দীর শেষের তুলনায় ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে এবং ভবিষ্যতে তা আরও ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বর্ষার সময়ও দীর্ঘায়িত হতে পারে। গাঙ্গে-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা পানি বিভাজন এলাকায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে বন্যা আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে। এই অঞ্চলে পরিবেশগত বিপর্যয় আরও গভীর হতে পারে, বিশেষত সুন্দরবনসহ দেশের বনভূমি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সুন্দরবন: প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার
সুন্দরবন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি, যা দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু, আজ এটি বাঁচার জন্য চরম সংগ্রাম করছে। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে পদ্মা নদীর পানির সরবরাহ কমে গেছে, ফলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবাহিত হচ্ছে এবং লবণাক্ততার কারণে সুন্দরী গাছসহ বেশ কিছু উদ্ভিদ মারা যাচ্ছে। এর ফলস্বরূপ, বনভূমির জীববৈচিত্র্য এবং মৎস্য উৎপাদনও বিপন্ন হচ্ছে।
বন উজাড় ও পরিবেশগত সমস্যা
আমরা যেভাবে নির্বিচারে বন উজাড় করছি, তা শুধু পরিবেশের জন্য নয়, আমাদের অর্থনীতির জন্যও বিপজ্জনক। দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার গাছ কাটা হচ্ছে, অথচ সেগুলোর প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে না। ফলস্বরূপ, বনভূমি সংকুচিত হচ্ছে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা পৃথিবীকে আরও গরম করছে। কাঠের চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন ইটভাটায় প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কাঠ ব্যবহৃত হচ্ছে, অথচ এর বিকল্প উপকরণের ব্যবহার বাড়ানো উচিত।
পরিবেশ রক্ষায় আমাদের করণীয়
এখনই সময়, পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চল সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে প্রথমত আমাদের বনভূমি রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া, পাহাড় কাটা ও নদী দূষণও রোধ করতে হবে। জনগণের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা তৈরি করতে এবং কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
আমরা যদি নিজেদের দায়িত্ব না বুঝি, তবে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের খেসারত সবাইকে মেটাতে হবে। আমরা যদি এখনই সতর্ক না হই, তাহলে ভবিষ্যতে যে বিরাট ক্ষতি হবে, তা কাটিয়ে উঠতে আমাদের অনেক সময় এবং প্রচেষ্টা প্রয়োজন হবে।
উপসংহার
পরিবেশ রক্ষা আমাদের সকলের দায়িত্ব। এটি শুধু সরকারের কাজ নয়, আমাদের প্রতিটি নাগরিকের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ দরকার। কেবল সচেতনতা সৃষ্টি নয়, আইন বাস্তবায়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে দ্রুত কার্যকর প্রযুক্তি ব্যবহার এবং বৈশ্বিক উদ্যোগ নেওয়ার মাধ্যমে আগামী দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।